ধন্য আমি পলান সরকারের ছেলে

পলান সরকার (৯ সেপ্টেম্বর ১৯২১—১ মার্চ ২০১৯)। ছবি: প্রথম আলো
পলান সরকার (৯ সেপ্টেম্বর ১৯২১—১ মার্চ ২০১৯)। ছবি: প্রথম আলো
প্রথম আলোর সঙ্গে পলান সরকারের সম্পর্ক ছিল হৃদ্যতার। সে হৃদ্যতার শুরুটা ২০০৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি। সেদিনই তাঁকে নিয়ে ‘বিনি পয়সায় বই বিলাই’ শিরোনামে ছুটির দিনে–তে প্রচ্ছদ প্রতিবেদন ছাপা হয়। এটিই তাঁকে নিয়ে প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রকাশিত প্রথম প্রতিবেদন। সেই আলোর ফেরিওয়ালা পলান সরকার চিরবিদায় নিলেন ১ মার্চ। তাঁর ছেলে হায়দার আলী স্মরণ করছেন বাবা পলান সরকারকে।

আমার বাবার জন্মের আগে আমার দাদির আরও কয়েকটি সন্তান মারা গেছেন। এ জন্য দাদি আমার বাবার নাম রেখে দিয়েছিলেন ‘পলানি’, মানে যে পালিয়ে যায়। দাদি ভেবেছিলেন, তাঁর এ ছেলেও পালিয়ে যাবে। কিন্তু দাদির কাছ থেকে তাঁর এই ছেলে পালিয়ে যায়নি। পালিয়ে গেলেন আমাদের জীবন থেকে।

একুশে পদক গলায় পরেই পলান সরকার ছুটে এসেছিলেন প্রথম আলো কার্যালয়ে। ছেলে হায়দার আলী দেখছিলেন ছুটির দিনে প্রকাশিত প্রতিবেদনটি। ২০১১ সাল। ছবি: প্রথম আলো
একুশে পদক গলায় পরেই পলান সরকার ছুটে এসেছিলেন প্রথম আলো কার্যালয়ে। ছেলে হায়দার আলী দেখছিলেন ছুটির দিনে প্রকাশিত প্রতিবেদনটি। ২০১১ সাল। ছবি: প্রথম আলো

৯৮ বছর বয়স হলেও তাঁর মৃত্যুকে আমরা পালিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই বলতে পারছি না। কারণ, বাবা এত বছর বয়সেও এক দিনও সেইভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকেননি। যেদিন মারা যান, সেদিনও সকালে অনেকক্ষণ চেয়ারে বসে ছিলেন। তবে গত ২১ ডিসেম্বর আমার মা রাহেলা খাতুনের মৃত্যুর পর বাবা একাকিত্বে ভুগতেন। এইটুকু আমরা বুঝতে পেরেছিলাম।
যাহোক, বাবার ‘পলানি’ নামটিই মানুষের মুখে মুখে একসময় ‘পলান’ হয়ে যায়। আসল নাম হারেজ উদ্দিন সরকার। সরকার পদবি যুক্ত হয়ে সমাজে বাবা ‘পলান সরকার’ হিসেবেই পরিচিত হয়ে ওঠেন। ছোটবেলায় আমার বাবা চরম অভাবের মধ্যে বেড়ে উঠেছেন। জন্মের পাঁচ মাসের মাথায় তাঁর জন্মদাতা পিতা পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। তাই এই অভিভাবকহীন বালকের চতুর্থ শ্রেণিতে ওঠার পর বই কেনার ব্যবস্থা হয়নি। চাচাতো ভাইয়ের সঙ্গে একই ক্লাসে পড়তেন। তাই পরিবারের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, দুই বছর একই ক্লাসে থাকতে হবে। তাহলে পরের বছর চাচাতো ভাইয়ের পুরোনো বই নিয়ে বাবা পড়তে পারবেন। তাই করে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত বাবার পড়ালেখা হয়েছিল। শুধু বইয়ের জন্য এক বছর পড়া বন্ধ করে বসে থাকার যে ব্যথা আমার বাবা শিশু বয়সে পেয়েছিলেন, আমার মনে হয়েছে, সেই বেদনাই বাবাকে সারা জীবন বইয়ের পেছনে ছুটতে বাধ্য করেছে। বাবা বইপাগল হয়ে উঠেছিলেন। কারও বাসায় দাওয়াত খেতে যাবেন, উপহার হিসেবে বই নিয়ে যাবেন। আমাদের চালকলে হালখাতার সময় কেউ সব বাকি শোধ করে দিলে বাবা তাঁকে একটি বই উপহার দিতেন। স্কুলে যাদের রোল নম্বর ১ থেকে ১০-এর মধ্যে থাকে, বাবা তাদের নিজের টাকা দিয়ে বই কিনে দেন। একপর্যায়ে পায়ে হেঁটে হেঁটে মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বই পড়ার আন্দোলন শুরু করেন।
শেষ পর্যন্ত আমাদের একটা আত্মতৃপ্তির জায়গা বাবা তৈরি করে গেলেন, যে বইয়ের জন্য একদিন বাবা কেঁদেছিলেন, সেই বই তিনি মানুষকে অকাতরে বিলিয়ে গেলেন। বইকে বাবা এত প্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছিলেন যে বই বাবাকে বিশ্বব্যাপী পরিচিত করেছে। এর পেছনে ছিল প্রথম আলোর নীরব ভূমিকা।
প্রথম আলোর উদ্যোগে ২০১৪ সালে ‘ইমপ্যাক্ট জার্নালিজম ডে’ উপলক্ষে বিশ্বের বিভিন্ন ভাষার ৪০টি প্রধান দৈনিকে একযোগে বাবার বই পড়ার আন্দোলনের গল্প ছাপা হয়। তারও আগে ২০০৭ সালে প্রথম আলোর শনিবারের ক্রোড়পত্র ‘ছুটির দিনে’ প্রচ্ছদ প্রতিবেদন ছাপা হয় ‘বিনি পয়সায় বই বিলাই’ শিরোনামে। এটিই তাঁকে নিয়ে প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রকাশিত প্রথম প্রতিবেদন। তার আগে ২০০৬ সালের ২৯ ডিসেম্বর বিটিভির ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’তে তাঁকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রচারিত হয়।
এখন পলান সরকার নামের সঙ্গে বই জিনিসটি একাকার হয়ে গেছে। তাই যেখানেই বইমেলা হয়েছে, সেখানেই বাবার ডাক পড়েছে। প্রায় অর্ধশত অনুষ্ঠানে আমি বাবার সঙ্গে গিয়েছি। আমার বাবা মানুষের এত ভালোবাসা পেয়েছেন যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি থাকলেও অনেক মানুষের ভাগ্যে এমন ভালোবাসা মেলে না। একুশে পদকপ্রাপ্তির অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে সব অনুষ্ঠানেই ছিলাম বাবার সঙ্গে। ফরিদপুরে শহীদ সুফী সমাজকল্যাণ সমিতি আমাদের পুরো পরিবারকে আমন্ত্রণ করেছিল। পাঁচ দিন তারা আমাদের এত খাতির-যত্ন করেছে, তা কোনো দিন ভুলবার নয়। রংপুরে বাবা ছিলেন অনুষ্ঠানের উদ্বোধক, এরশাদ ছিলেন প্রধান অতিথি। আমি পাশে থেকে আমার বাবার প্রতি মানুষের আবেগ প্রকাশ করতে দেখেছি। সর্বশেষ গত ৮ ডিসেম্বর বাংলা একাডেমি বাবাকে সম্মানসূচক ফেলোশিপ প্রদান করেছে। সেদিন বাবার শরীর খারাপ থাকার কারণে আমিই বাবার পক্ষ থেকে পুরস্কার নিতে গিয়েছিলাম। সেদিন নিজেকে খুবই সম্মানিত মনে হয়েছে কিন্তু বাবার অভাব আমি টের পেয়েছি।
আমার উপলব্ধি হয়েছে, আমার বাবার জন্ম হয়েছিল বোধ হয় শুধু মানুষকে দেওয়ার জন্যই। নিজের কোনো চাহিদা ছিল না। ১৯৬৫ সালেই নিজের জমিতে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তারপর থেকে একে একে বাবা নিঃস্বার্থভাবে মানুষের মনে জ্ঞানের আলো জ্বেলে গেছেন। আজ সবার কাছে আমার একটাই মিনতি, মানুষের প্রার্থনায় মানুষের মঙ্গল হয়। আপনাদের দোয়ায় আমার বাবার আত্মা শান্তি পাবে। দোয়াই আমার বাবার জন্য আপনাদের কাছে শেষ চাওয়া।
অনুলিখিত