এই নারীরা মুক্তা ফলান

নেত্রকোনার আনোয়ারা রিজভী এখন মুক্তাচাষি নামে পরিচিত। তাঁর স্বামী আবদুল্লাহ আল মামুন যে পুকুরে মাছ চাষ করেন, সেই পুকুরেই আনোয়ারা মুক্তা চাষ করছেন। ৬ মার্চ বিকেলে দেখা হয় এই দম্পতির সঙ্গে। ২৫ বছর বয়সী আনোয়ারা রিজভী বললেন, ‘মুক্তা এমন একটি রত্ন, যাকে পেতে হলে ঝিনুককে যত্ন করতে হয়।’

ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজে এমকম (হিসাববিজ্ঞান) পড়ুয়া সাবিনা আক্তারও মুক্তাচাষি। সাবিনা ইউটিউবে মুক্তা চাষের পদ্ধতি দেখেছিলেন।

আনোয়ারা ও সাবিনা ময়মনসিংহের বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে ‘স্বাদু পানির ঝিনুকে মুক্তা চাষ’ শীর্ষক প্রশিক্ষণ নিয়ে মাঠে নেমেছেন। সাবিনাকে সহায়তায় এগিয়ে এসেছেন তাঁর তিন ভাই।

সাবিনা জানালেন, শ্রমিক দিয়ে উপজেলার বিভিন্ন এলাকার খাল-বিল থেকে স্বাদু পানির প্রায় দুই হাজার ঝিনুক সংগ্রহ করেন তিনি। এর মধ্যে প্রায় এক হাজার ঝিনুকের মধ্যে তিনি অস্ত্রোপচার করে ইমেজ (মুক্তার বীজ) প্রতিস্থাপন করে বিশেষ পদ্ধতিতে পানিতে রেখে দেন। ৫০০ ঝিনুক ছেড়ে দেন পারিবারিক পুকুরে (এক একর)। এতে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। পুকুরে মাছ চাষের পাশাপাশি ঝিনুকগুলোও বেড়ে উঠছে। মাছের জন্য দেওয়া খাবারই ঝিনুকগুলোর খাবার। আগামী জুন-জুলাই মাস থেকে ওই সব ঝিনুক থেকে মুক্তা আহরণ শুরু হবে।

গত ১৮ ফেব্রুয়ারি মধ্যপ্রাচ্যপ্রবাসী সাইদুল ইসলামের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে সাবিনার। ১৫–২০ দিন পরপর শ্বশুরবাড়ি থেকে বাবার বাড়ি এসে ঝিনুকগুলোর খোঁজখবর নিচ্ছেন তিনি। সম্প্রতি কয়েকটি ঝিনুক পুকুর থেকে উঠিয়ে পরীক্ষা করে ঝিনুকে মুক্তার অস্তিত্ব দেখতে পেয়েছেন। আর কয়েক মাসের অপেক্ষা। সফল হলে বাণিজ্যিকভাবে মুক্তা চাষে নামবেন তিনি।

মুক্তাচাষি সাবিনা আক্তার।  ছবি: বদর উদ্দিন ও আনোয়ারা রিজভী।  ছবি: সংগৃহীত
মুক্তাচাষি সাবিনা আক্তার। ছবি: বদর উদ্দিন ও আনোয়ারা রিজভী। ছবি: সংগৃহীত

এইচএসসি পাসের পরই আনোয়ারাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়। স্বামী মামুনের সহযোগিতায় সংসারের হাল ধরেও লেখাপড়া চালিয়ে যান। ভর্তি হন নেত্রকোনা সরকারি কলেজে পদার্থবিজ্ঞানে অনার্সে। এর মধ্যে কোলজুড়ে এল মেয়ে নুরজাহান শেখ। তিন বছরের মেয়ে, সংসার সামাল দিয়ে এ বছর প্রথম শ্রেণিতে অনার্স পাস করেছেন আনোয়ারা। এবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বিসিএস পরীক্ষার জন্য। পড়াশোনার সময় মুক্তা চাষের কথা জানতে পারেন তিনি।

প্রথমে স্বামী মামুনকে ময়মনসিংহে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটে মুক্তা চাষের প্রশিক্ষণ নিতে পাঠালেন। স্বামীর কাছ থেকে মুক্তা চাষের কলাকৌশল রপ্ত করে আনোয়ারা নিজেই প্রশিক্ষণ নিলেন। সার্টিফিকেট পেয়ে এবার শুরু করেছেন মুক্তা আহরণের পর্ব। স্বামীর পুকুরটিতে দেড় শ ঝিনুক ছাড়া হয়েছে। সেসব ঝিনুক থেকে মিলতে শুরু করেছে মুক্তা। কিছুদিন পর বিক্রির কাজও শুরু করবেন আনোয়ারা রিজভী। বাংলাদেশে স্বাদু পানিতে প্রথমবারের মতো মুক্তা চাষ পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোহসেনা বেগমের নেতৃত্বে একদল গবেষক। প্রাথমিক সাফল্য পাওয়ার পর ২০১৫ সাল থেকে প্রশিক্ষণ কর্মসূচি শুরু হয়। এ পর্যন্ত এক হাজারজনকে বিনা মূল্যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, যাঁদের মধ্যে ৮০০ জনই নারী।

মোহসেনা বেগম বলেন, মুক্তা চাষের জন্য অস্ত্রোপচার অনেকটা সূচি কাটার মতো। ঘরে বসে যেমন কাপড় সেলাই করা যায়, তেমনি ঝিনুককে অস্ত্রোপচারও ঘরে বসেই করা যায়। খুব অল্প খরচে সরঞ্জাম কেনা যায়। ধৈর্য ধরলে ভালো মুক্তা মেলে, লাভ পাওয়া যায়। মোহসেনা বেগম বলেন, গ্রামে প্রতিটি বাড়ির সঙ্গেই ছোট–বড় পুকুর কিংবা ডোবা রয়েছে। বাড়ির মা–বোনেরা ঘণ্টা দুই ব্যয় করলেই ৫০-৬০টি ঝিনুক প্রতিদিন অস্ত্রোপচার করতে পারেন। সাত মাসে ২০ টির মতো মুক্তা পাওয়া যেতে পারে। মুক্তা চাষের বিশেষ দিক হলো, ঝিনুককে বাড়তি খাবার দিতে হয় না। ঝিনুক নিজে থেকেই খাবার নিয়ে নেয়। উল্টো পুকুরের পানি মাছ চাষের জন্য উপযোগী করে তোলে ঝিনুক।

মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ইয়াহিয়া মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে মুক্তা চাষপদ্ধতি মৎস্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে মাঠপর্যায়ে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। দেশে বর্তমানে তিন ধরনের মুক্তা চাষ হচ্ছে।

প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে নারীসহ অনেক চাষি মুক্তা চাষ শুরু করেছেন। তবে উৎপাদনের পর মুক্তা বাজারজাতের ব্যবস্থা করতে হবে। বাজারজাত না করতে পারলে চাষিরা মুক্তা চাষে উৎসাহ হারাবেন।