প্রাপ্যটুকু পেতেও ভোগান্তি

>

* মুসলিম নারীদের সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার দেওয়া হয়েছে
* তবে নারী-পুরুষ সমান পাচ্ছে না
* হিন্দু নারীরা সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয় না
* খ্রিষ্টান নারীরা বাবার সম্পত্তিতে সমান ভাগ পায়
* ক্ষুদ্র জাতিসত্তার নারীদের বেলায় সম্পত্তির হিসাব-নিকাশ চলে নিজস্ব প্রথাগত আইনে

আয়শা খানম
আয়শা খানম

উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে নারীরা সমানাধিকার পাচ্ছে না। এ বৈষম্য শুধু নারী বলেই নয়, এ বৈষম্য হচ্ছে ধর্মভেদে। কেননা উত্তরাধিকার সম্পত্তির বিষয়টি ধর্মভিত্তিক পারিবারিক আইনের মাধ্যমে মীমাংসা করা হচ্ছে। একদিকে সমানাধিকার পাচ্ছে না, অন্যদিকে প্রাপ্য যেটুকু তা পেতেও নারীদের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।

বর্তমানে সরকারও উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে সমানাধিকারের জায়গা থেকে সরে এসে পারিবারিক বা নিজস্ব আইনে নারী যাতে তার প্রাপ্যটুকু পায় তা নিশ্চিত করার কথা বলছে।

মুসলিম নারীদের সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার দেওয়া হয়েছে, তবে নারী-পুরুষ সমান পাচ্ছে না। খ্রিষ্টান নারীরা বাবার সম্পত্তিতে সমান ভাগ পায়। হিন্দু নারীরা সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয় না। ক্ষুদ্র জাতিসত্তার নারীদের বেলায় সম্পত্তির হিসাব-নিকাশ চলে নিজস্ব প্রথাগত আইনে।

২০১৩ সালে আইন কমিশন বাংলাদেশে মুসলিম পারিবারিক আইনের পর্যালোচনা ও সুপারিশের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলেছে, প্রত্যেক ধর্মে প্রচলিত পারিবারিক আইন নারীর প্রতি কম-বেশি বৈষম্যমূলক। এতে নারীর মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়। এই বৈষম্য যতটা না আইনের মূল উৎসের কারণে, তার চেয়ে অনেক বেশি উৎসের আক্ষরিক, প্রেক্ষাপটহীন ও স্বার্থবাদী ব্যাখ্যার কারণে।

বাবার সম্পত্তি পেতে ভোগান্তি প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নারী জানালেন, তাঁরা তিন বোন এবং এক ভাই। আইন অনুযায়ী ভাই বোনদের চেয়ে সম্পত্তির বেশি ভাগ পাবেন। ঝগড়াঝাটির পর ভাই বোনদের ভাগ দিতে রাজি হয়েছেন, তবে শর্ত হলো শহরের জমি থেকে বোনেরা কিছু পাবেন না, গ্রামে যেসব জমি (দামে কম) আছে, নিতে হলে তা থেকেই নিতে হবে।

রাজধানীর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক হিন্দু নারী আক্ষেপ করে বললেন, ‘বিয়ের সময় আলাদা করে বাবা কিছু টাকা দিয়েছেন, তা-ই আমার সম্বল। স্বামীর কাছ থেকে কোনো সম্পত্তির মালিকানা দাবি করার অধিকারই তো আমার নেই।’

প্রচলিত আইন অনুযায়ী হিন্দু নারীরা শুধু সীমিত স্বার্থে ও শর্ত সাপেক্ষে সম্পত্তির মালিক হন।

আইন কমিশন ২০১২ সালে হিন্দু পারিবারিক আইন সংস্কারের সুপারিশবিষয়ক চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলেছে, বাংলাদেশে এ আইন সংস্কার না হওয়ার পেছনে ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক কারণও রয়েছে।

অলংকরণ: শাকিলা খান
অলংকরণ: শাকিলা খান

এ প্রতিবেদন তৈরিতে গবেষণা জরিপের তথ্য বলছে, উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে নারীরা সম্পত্তির অধিকার পেতে পারে কি না?–প্রশ্নের উত্তরে ৮৬ শতাংশ এবং জীবনস্বত্বের পরিবর্তে নারীরা সম্পত্তিতে পূর্ণ অধিকার পেতে পারে কি না?– প্রশ্নের উত্তরেও ৮২ শতাংশই হ্যাঁ বলেছেন।

তবে আইন কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করে আইন প্রণয়ন বা সংশোধনের বিষয়টি সরকারের উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে।

দেশে খ্রিষ্টান নারীরা কিছুটা ভালো অবস্থানে আছেন। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হেলেনা হালদার লিমা বলেন, খ্রিষ্টান ধর্মে উত্তরাধিকার সম্পত্তির ক্ষেত্রে ছেলে-মেয়েতে কোনো বিভেদ নেই। স্ত্রীও স্বামীর সম্পত্তির ভাগ পান।

২০১৪ সালে ইন্টারন্যাশনাল ল্যান্ড কোয়ালিশনের সহায়তায় ‘অ্যাসেসিং ইনহেরিটেন্স ল’জ অ্যান্ড দেয়ার ইমপ্যাক্ট অন রুরাল উইমেন ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণা বলছে, গ্রামাঞ্চলে সত্যিকার অর্থে নারীদের উত্তরাধিকারসূত্রে মালিকানা থাকা জমির পরিমাণ ৪ শতাংশের বেশি না। গবেষণায় মুসলিম, হিন্দু, চাকমা, গারো এবং সাঁওতাল নারীদের অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে।

গবেষণাটি বলছে, চাকমাদের মধ্যে পুত্র না থাকলে তখনই শুধু কন্যারা উত্তরাধিকার হবে। মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় গারো নারীদের জমিতে মালিকানা থাকলেও তা থাকে পুরুষের নিয়ন্ত্রণে। সাঁওতাল নারীরা বাবা বা স্বামীর সম্পত্তিতে কোনো ভাগ পায় না।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ ৮০’র দশক থেকে সব ধর্মের নারীর পারিবারিক জীবনে সমতা, সমানাধিকার ও সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়নের দাবি জানিয়ে আসছে। এ দাবিও সরকারের উচ্চপর্যায়ে তেমন কোনো রেখাপাত করতে পারেনি।

বর্তমান সরকার টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকলেও অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়ন, জাতিসংঘের সিডও সনদের দুটি গুরুত্বপূর্ণ সংরক্ষিত ধারা প্রত্যাহার, বৈষম্যমূলক আইন সংশোধনের মতো বিষয়গুলোতে হাত দেয়নি।

২০১১ সালে সরকারের প্রণীত জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিতে সমানাধিকারের বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে বলা হয়, উপার্জন, উত্তরাধিকার, ঋণ, ভূমি ও বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অর্জিত সম্পদের ক্ষেত্রে নারীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের অধিকার থাকবে।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়শা খানম বলছেন, সম্পত্তিতে নারীর সমানাধিকার বাস্তবায়নে সরকারের সদিচ্ছা দেখা যাচ্ছে না। সরকারকে মনে রাখতে হবে, স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তিতে নারীর সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা না করলে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন সম্ভব হবে না।

অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (এএলআরডি) নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলছেন, উত্তরাধিকার সম্পত্তি পাওয়ার বিষয়টিতে অনেক নারীও সচেতন নন। কথা চিন্তা করে নারীরা প্রাপ্য সম্পত্তি পেতে বঞ্চিত হলেও আইনের আশ্রয় নিচ্ছেন না।