সাভার, আশুলিয়ায় নারীদের আত্মহত্যার ঝুঁকি বেশি

অলংকরণ: তানজিনা নাজনীন
অলংকরণ: তানজিনা নাজনীন
>

• ঢাকায় নারীদের আত্মহত্যা
• সাভার, আশুলিয়ায় ঝুঁকি বেশি
• গত তিন মাসে (জানুয়ারি থেকে ৩০ মার্চ পর্যন্ত) ঢাকায় ১১৩ জন নারী আত্মহত্যা করেছেন
• গত তিন মাসে আশুলিয়া এলাকায় ২৬ জন ও সাভারে ১৬ জন নারী আত্মহত্যা করেন

চার বছরের সংসার ও ৮ মাস বয়সী ফুটফুটে সন্তান রেখে গত ১০ মার্চ আত্মহত্যা করেন জোছনা বেগম (২০)। জোছনাকে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগে স্বামী হাসান মণ্ডলের বিরুদ্ধে আশুলিয়া থানায় মামলা করেন জোছনার ভাই মজনু মিয়া।

শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের কারণে ২৩ বছর বয়সী এলিজা খাতুনের সংসার টেকে মাত্র আড়াই বছর। গত ১৬ মার্চ এলিজার আত্মহত্যার পর তাঁর স্বামী সাভারের সজীবের বিরুদ্ধে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগে মামলা করেছেন এলিজার বাবা আল আমিন।

এ তো বলা হলো মাত্র কয়েকটি ঘটনা। সাভার, আশুলিয়া ও ধামরাইয়ের মতো এলাকাগুলোয় আত্মহত্যা এখন আর চমকে দেয় না। মামলার নথি, বিভিন্ন থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঢাকার আশুলিয়া ও সাভার থানা এলাকায় আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। কিশোরী, তরুণী ও গৃহবধূরাই বেশি আত্মহত্যা করছেন। প্রথম আলোর অনুসন্ধান বলছে, গত তিন মাসে আশুলিয়া এলাকায় ২৬ জন নারী ও সাভারে ১৬ জন নারী আত্মহত্যা করেন। এ ছাড়া গত বছরে আশুলিয়ায় আত্মহত্যা করেছেন ৬৩ জন এবং সাভারে ৩০ জন।

মনোরোগ চিকিৎসকেরা বলছেন, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হন নারীরা। কষ্টের সময়টাতে এই নারীরা পরিবার বা রাষ্ট্র কাউকেই পাশে পাচ্ছেন না। একপর্যায়ে মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হন তাঁরা। কিন্তু বেশির ভাগই চিকিৎসার আওতায় আসছেন না।

আশুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ রিজাউল হক বললেন, ঢাকার মধ্যে আত্মহত্যার ক্ষেত্রে চরম ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হচ্ছে আশুলিয়া ও ধামরাই এলাকা। প্রায় প্রতিদিনই এই এলাকায় দুই-একজন নারী আত্মহত্যা করছেন। অনেক আত্মহত্যার ঘটনা পুলিশকে জানানোই হয় না। এসব এলাকায় আত্মহত্যার প্রধান কারণ দাম্পত্য কলহ। তবে আত্মহত্যাকারীর স্বজনদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দাম্পত্য কলহের বাইরেও অনেকে মানসিক সমস্যার কারণে আত্মহত্যা করছেন।

শিল্পী (২০) আর শরীফা (৩০) দুই বোন আশুলিয়ায় একটি পোশাকশিল্প কারখানায় কাজ করতেন। দুই সন্তানের মা শরীফা গত ২৭ মার্চ আশুলিয়ার ভাড়া বাসায় আত্মহত্যা করেন। শিল্পী প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর বোন অনেক দিন থেকে মানসিক সমস্যায় ভুগছিলেন। তবে তেমনভাবে কোনো চিকিৎসা করানো হয়নি।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চিকিৎসক হেলাল উদ্দিন আহমেদ বললেন, সম্পর্কের নানান জটিলতায় নারীরা আত্মহত্যা করছেন। অন্যভাবে বলা যায়, আত্মহত্যার বড় কারণ এটি। নারীদের মধ্যে মানসিক কোনো সমস্যা দেখা দিলে অবহেলা করা যাবে না। আত্মহত্যা রোধ করতে হলে অবশ্যই নারীকে চিকিৎসার আওতায় আনতে হবে।

ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম) এবং ঢাকার মুখ্য বিচারিক হাকিম (সিজিএম) আদালতের সাধারণ নিবন্ধন খাতার তথ্য বলছে, ঢাকায় গত বছর ৩৪৪ জন নারী আত্মহত্যা করেছেন। এর মধ্যে ঢাকা মহানগর এলাকায় আত্মহত্যা করা নারীর সংখ্যা ২০৮ এবং ঢাকা জেলায় আত্মহত্যা করেছেন ১৩৬ জন নারী।

প্রথম আলোর হাতে আসা সম্প্রতি সময়ে ঘটে যাওয়া আত্মহত্যার প্ররোচনা এবং আত্মহত্যাসংক্রান্ত অপমৃত্যুর ২২টি মামলার কাগজপত্র পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ঢাকায় সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করেছেন গৃহবধূরা। স্বামীর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন সইতে না পেরে এসব নারী আত্মহত্যা করেছেন। এঁদের বয়স ১৮ থেকে ৩০–এর মধ্যে। অন্যদিকে, গত ১৫ মাসে ঢাকা জেলায় আত্মহত্যা করেছেন—এমন ১২৬ জন নারীর বয়সের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ১১ থেকে ২০ বছর বয়সের ৬৫ জন আর ২১ বছর থেকে ২৫ বছর বয়সী ৪৯ জন নারী আত্মহত্যা করেছেন। অর্থাৎ, ১১ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে এই সংখ্যা ১১৪। আত্মহত্যা করা তালিকা থেকে ৭০ বছর বয়সী নারীও বাদ যাননি।

ঢাকার আদালতের সাধারণ নিবন্ধন খাতার তথ্য বলছে, গত তিন মাসে (জানুয়ারি থেকে ৩০ মার্চ পর্যন্ত) ঢাকায় ১১৩ জন নারী আত্মহত্যা করেছেন। এর মধ্যে ঢাকা জেলার পাঁচটি থানা এলাকায় আত্মহত্যা করেছেন ৫২ জন। ঢাকা মহানগরের ৫০টি থানা এলাকায় আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন ৬১ জন নারী।

ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) শাহ মিজান শাফিউর রহমান বললেন, ঢাকা জেলায় এক হাজারের বেশি পোশাকশিল্প কারখানা আছে। ঢাকা মহানগরেই আছে প্রায় ৭০০ কারখানা। সাভার ও আশুলিয়াতেই প্রায় ১৮ লাখ শ্রমিক বাস করেন। এই শ্রমিকদের বেশির ভাগই আয়রোজগার কম বলে জীবনধারণের জন্য অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে বাধ্য হচ্ছেন। হতাশার মধ্যে দিন কাটে অনেক শ্রমিকের। এ কারণে সংসারে এমনিতেই অশান্তি লেগে থাকে। অন্যদিকে, এসব এলাকায় নারী শ্রমিকসহ বিভিন্ন পেশার নারীরা বিয়ের নামে প্রতারণার শিকার হন। স্বল্পশিক্ষিত, অসচেতন এই নারীদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা বা প্রতিকূলতা মোকাবিলা করার সক্ষমতাও থাকে না।

এ ছাড়া পরীক্ষায় খারাপ ফল, মা–বাবার বকাঝকা, মুঠোফোন, ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে আসক্তির পর মা–বাবার শাসনসহ বিভিন্ন কারণে বিশেষত কিশোরীরা আত্মহত্যা করছে।

১৩ বছর বয়সী নাদিয়া সাভারের একটি স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ত। গত ৪ ফেব্রুয়ারি আত্মহত্যা করা নাদিয়ার বাবা আনোয়ারুল হক বলেন, স্কুল থেকে দেরি করে বাড়ি ফেরা নিয়ে বকাঝকা করায় মেয়ে আত্মহত্যা করে।

মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ন্যাশনাল ট্রমা কাউন্সেলিং সেন্টারের প্রধান ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ইসমত জাহানের মতে, শারীরিক নির্যাতনের চেয়েও মানসিক নির্যাতন নারীর আত্মহত্যার বড় একটি কারণ। ঘরে-বাইরে নারী অবহেলার শিকার। নারীকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হয়। এ ধরনের পরিস্থিতিতে নারীর আত্মবিশ্বাস শূন্যের কোঠায় নেমে আসে। এই নারীদের প্রতি আরও মানবিক হতে হবে। প্রশিক্ষিত কাউন্সেলরের মাধ্যমে কাউন্সেলিং করতে হবে।

আত্মহত্যা করা বহু নারীর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলা স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অবসরে যাওয়া ফরেনসিক চিকিৎসক হারুন-উর-রশীদ বলেন, অভাব-অনটনে হতাশ হয়েও অনেক নারী আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন। অনেক অন্তঃসত্ত্বা নারীও আত্মহত্যা করছেন। অথচ এই নারীদের পাশে যদি পরিবার, সরকার বা বেসরকারি কোনো সংগঠন দাঁড়াত, তাহলে তাঁদের পায়ের তলার মাটি শক্ত হতো। কাউন্সেলিংয়ের সুযোগ পেলে তাঁদের মানসিক শক্তি বাড়ত। এতে আত্মহত্যার হাত থেকে এসব নারীকে বাঁচানো সম্ভব হতো।