সুযোগ-সংকটে হারাচ্ছে সম্ভাবনা

দেশের শ্রমশক্তিতে থাকা সম্ভাবনাময় সাড়ে ৩৪ লাখ নারীকে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। এই নারীদের কেউ কেউ পছন্দমতো কাজ পাচ্ছেন না। অনেকে আবার সংসারের ঝক্কিঝামেলায় চাকরি করতে পারছেন না।

সাবেরা সাকিব স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী। টানা পাঁচ বছর সাভারের রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে (ইপিজেড) অবস্থিত বিদেশি প্রতিষ্ঠান ইয়াংওয়াংয়ে কাজ করেছেন। সন্তানসম্ভবা হওয়ার পর দেড় বছর আগে ওই চাকরি ছেড়ে দেন। সন্তান জন্মের পর আর নতুন কোনো চাকরিতে যোগ দেননি। তিনি নতুন করে চাকরি চান, কিন্তু পছন্দমতো কাজ না পাওয়ায় বসে আছেন।

একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে তিন বছর ধরে বেকার বসে আছেন কায়নাজ মোস্তফা। যে দু-একটি চাকরির সন্ধান পেয়েছেন, তাতে এত কম বেতন যে, যাতায়াতেই প্রায় সব টাকা চলে যাবে।

এভাবে দেশের সম্ভাবনাময় ও চাকরিপ্রার্থী নারীদের কাজে লাগানো যাচ্ছে না।

গত বছর প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৬-১৭ প্রতিবেদন বলছে, সাবেরা, কায়নাজদের মতো দেশে এমন নারীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৩৪ লাখ। সম্ভাবনাময় নারী জনশক্তির অপচয় হচ্ছে। পরোক্ষভাবে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রায় ৬৬ লাখ এমন ছদ্মবেকার আছে। অনেক শিক্ষিত নারী গৃহিণী নামের ‘পেশা’ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছেন, যে কাজের কোনো স্বীকৃতি নেই। অর্থনীতির ভাষায় এই বিপুলসংখ্যক নারী জনগোষ্ঠীকে কর্ম–উপযোগী সম্ভাবনাময় শ্রমশক্তি বলা হয়।

বিবিএসের জরিপ প্রতিবেদন বলছে, দেশের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর ৬৫ লাখ ৭৫ হাজার জন স্থায়ী কোনো কাজ করেন না। এর মধ্যে নারীর সংখ্যাই বেশি। স্থায়ী কাজহীন কর্মক্ষম নারীর দুই-তৃতীয়াংশ বা সোয়া ২১ লাখ নারীর বয়স ১৫ থেকে ২৯ বছরের মধ্যে।

সার্বিকভাবে কর্ম–উপযোগী এই জনগোষ্ঠীকে তিন শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে। শ্রেণিগুলো হলো বেকার, খণ্ডকালীন কর্মজীবী ও সম্ভাবনাময় জনগোষ্ঠী। এই তিন শ্রেণিতেই উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নারী আছেন। বিবিএসের জরিপ অনুযায়ী, খণ্ডকালীন কাজ করেন ১৪ লাখ ৬৫ হাজার জন। এর মধ্যে নারীর সংখ্যা ৫ লাখ ৩৯ হাজার।

অন্যদিকে কাজ খুঁজেও পাননি; এখন পুরোপুরি বেকার-এমন নারী-পুরুষের সংখ্যা ২৬ লাখ ৭৭ হাজার। শ্রেণিতে নারী ও পুরুষের সংখ্যা প্রায় সমান। প্রায় সাড়ে ১৩ লাখ করে নারী-পুরুষ বর্তমানে পুরোপুরি বেকার। আরেকটি শ্রেণি রয়েছে, যারা বিবিএস যখন জরিপটি করেছে, তখন কোনো কারণে কাজের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না; কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যেই কাজ খোঁজা শুরু করবেন। এমন ব্যক্তি রয়েছেন ২৪ লাখ ৩৪ হাজার জন। এই শ্রেণির বেকারদের প্রায় ১৭ লাখই নারী।

অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, বাংলাদেশের শ্রমবাজারে নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ব্যাপক বৈষম্য বিদ্যমান। কর্মজীবীদের মধ্যে ৭০ শতাংশই পুরুষ; নারী মাত্র ৩০ শতাংশ। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বললেন, ‘বর্তমানে অনেক শিক্ষিত নারী কাজ করতে পারছেন না। আবার অনেকের শিক্ষা নেই, কিন্তু কাজে যেতে চান। তাঁদের শ্রমবাজারের উপযোগী কাজের জন্য প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এমন নারীদের অনেকেই নিজেরা কিছু করতে চান, আত্মকর্মসংস্থান চান। তাঁদের সেই সুযোগ করে দিতে হবে। এ দেশে ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে অনেক নারী স্বাবলম্বী হয়েছেন।’

ফাহমিদা খাতুনের মতে, সন্তান লালনপালন ও পারিবারিক দায়িত্বের কারণে অনেকে চাকরিতে যেতে পারছেন না। তাই প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র তৈরির পাশাপাশি অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। নগরকেন্দ্রিক চাকরির জন্য যাতায়াত ও বাসস্থান একটি বড় সমস্যা। কর্মজীবী নারীদের জন্য এসব সুবিধা বাড়ানো হলে অনেক নারী কাজে যেতে আগ্রহী হবেন।