ঘরের ভেতরে গৃহকর্মীদের নীরব কান্না

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

মা হারানো ১২ বছর বয়সী লামিয়া বরিশালে আশরাফুল-শারমিন দম্পতির বাড়িতে এসে প্রথমে তাঁদের ছোট বাচ্চাকে দেখাশোনা করত। পরে তাকে দিয়ে বাড়ির ভারী কাজ করতে বাধ্য করা হয়। কাজ পছন্দ না হলেই তার ওপর নির্যাতন চালানো হতো। বাড়ি ফিরে যেতে চাইলে তাঁরা তার মাথার চুল কেটে দেন এবং মারধর করেন। নির্যাতনের কারণে তার দুই হাতে ক্ষতের সৃষ্টি হয়। চিকিৎসা না করানোয় তাতে পচন ধরে। পরে গোপন তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশ তাকে ‘আকাশ মঞ্জিল’ নামের ওই বাড়ি থেকে মুক্ত করে। (সূত্র: প্রথম আলো)

এ তো কেবল একটি ঘটনা। গৃহকর্মীর কাজ করতে গিয়ে নারী ও শিশুরা নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়। হত্যার ঘটনাও ঘটে। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) পরিচালিত এক গবেষণায় বর্তমানে বাংলাদেশের গৃহকর্মীদের অবস্থা, নির্যাতনের নানা দিক তুলে ধরা হয়েছে। মাঠপর্যায়ে ৫০০ জন গৃহকর্মীর ওপর গবেষণা চালিয়ে এই প্রতিবেদন তৈরি করেছে আইএলও।

আইএলওর গবেষণা বলছে, দেশে মোট গৃহকর্মীর ৬৬ দশমিক ৩ শতাংশ বাসাবাড়িতে থেকে কাজ করে। আর ৫৪ দশমিক ৪ শতাংশ খণ্ডকালীন কাজ করে। গৃহকর্মীর কাজে নিয়োজিত থাকেন মূলত নারীরাই, এটা ৯৭ শতাংশ। মাত্র ৩ শতাংশ পুরুষ গৃহকর্মী দেখা যায়, যাদের সবাই শিশু।

গৃহকর্মীদের নির্ধারিত কোনো কর্মঘণ্টা নেই। সাপ্তাহিক ছুটি বা অবসর নেই। এমনকি ঘুমানোর কোনো নির্দিষ্ট স্থানও নেই। সামান্য ত্রুটিতে মারধর, ঠিকমতো খাবার না দেওয়া, বেতন কম দেওয়া, বাড়িতে যেতে না দেওয়ার অভিযোগ তো আছেই।

আইএলও ওই গবেষণায় বলছে, বাড়িতে পূর্ণকালীন কাজে থাকা গৃহকর্মীদের ৪৮ শতাংশই নিদারুণভাবে মৌখিক নির্যাতনে শিকার হয়, ২৫ দশমিক ৯ শতাংশের ওপর চলে চরম মানসিক নির্যাতন। এ ছাড়া ১২ দশমিক ৯ শতাংশ শারীরিক নির্যাতনের শিকার। ৩ শতাংশ গৃহকর্মী যৌন নির্যাতনের কথা বলেন। প্রায় ৬৬ শতাংশ গৃহকর্মী জানান, রাতের ঘুমানোর সময় নিজেদের নিরাপদ মনে করেন না তাঁরা।

২০১৫ সালের গৃহকর্মীদের সুরক্ষা ও কল্যাণে প্রণীত নীতিমালা অনুযায়ী, গৃহকর্মীর বয়স ন্যূনতম ১৪ বছর হবে এবং তাকে হালকা কাজ করাতে হবে। এ ছাড়া ১২ বছর বয়সের কাউকে গৃহকর্মী হিসেবে রাখতে হলে তার আইনানুগ অভিভাবকের সঙ্গে তৃতীয় কোনো পক্ষের উপস্থিতিতে নিয়োগকারীকে আলোচনা করতে হবে। গৃহকর্মীরা সবেতনে ১৬ সপ্তাহের মাতৃত্বকালীন ছুটি পাবেন। গৃহশ্রমিকদের সহায়তার জন্য হেল্পলাইন চালু। এ ছাড়া কোনো গৃহকর্মী যৌন হয়রানি ও নির্যাতন, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের অভিযোগে মামলা করলে সরকারকে সেই মামলা পরিচালনার খরচ দিতে হবে। নীতিমালাটি বাস্তবায়নে শ্রম মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি তদারকি সেল রয়েছে। কোনো গৃহকর্মী বঞ্চনা বা নির্যাতনের শিকার হলে মনিটরিং সেল, মানবাধিকার ও শ্রমিক সংগঠনের কাছে টেলিফোনে, মৌখিক বা লিখিতভাবে অভিযোগ করতে পারেন।

আইনজীবী সালমা আলী বলেন, নীতিমালা মানা হচ্ছে না। অনেক বাসাতেই ১০ বছর বয়সের নিচেও গৃহকর্মী রয়েছে। গৃহকর্মকে শ্রম হিসেবে ধরা হয় না। ফলে, এই মেয়েদের নিজস্ব ‘কর্মপরিচয়’ নেই। নির্যাতনের ঘটনায় আদালতের বাইরেই সমঝোতা করে অর্থের বিনিময়ে মিটমাট করে ফেলা হয়। মামলা হলেও সেগুলোর মীমাংসা হতে দীর্ঘ সময় লাগে।

গৃহকর্মীদের বেতন–ভাতার ক্ষেত্রে ন্যূনতম মজুরিকাঠামো নেই। মৌখিক চুক্তিতে বেতন নির্ধারণ হয়। পূর্ণকালীন গৃহকর্মীদের ১৯ দশমিক ৬ শতাংশ ও খণ্ডকালীন গৃহকর্মীর ২৪ দশমিক ২ শতাংশ ৫ হাজার ৬০০ টাকা বা এর বেশি বেতন পায়। তবে বাড়িতে থাকা গৃহকর্মীরা নিজেদের বেতন খুব কমই নিজেরা নিতে পারেন। বেশির ভাগ সময় গৃহকর্মীর বাবা–মা অথবা আত্মীয় এসে বেতন তুলে নিয়ে যায়। আইএলওর গবেষণায় দেখা যায়, ২৬ দশমিক ৭ শতাংশের বেতন তুলে নিয়ে যান অন্যরা।

গৃহকর্মীদের শ্রমকে ‘শ্রম’ হিসেবে ধরা হয়নি শ্রম আইনে। শ্রমিক হিসেবে তাঁদের কোনো আইনগত স্বীকৃতি নেই। আইএলও ৫০০ গৃহকর্মীর কাছে জানতে চায়, কর্মক্ষেত্রে বিপদে পড়লে বা প্রয়োজন পড়লে কার কাছে যাবে? মাত্র নয়জন জানান, ট্রেড ইউনিয়নের সাহায্য নেবেন তাঁরা। ২১৪ জন মনে করেন, সরকারি সংস্থা তাঁদের সাহায্য করবে। তবে ঢাকায় শ্রমিক নিরাপত্তা ফোরাম ও গৃহশ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা নেটওয়ার্কের (ডিডব্লিউআরএন) অন্তভুক্ত এনজিও ও ট্রেড ইউনিয়নের সংখ্যা খুবই কম। কেবল ১০টি ট্রেড ইউনিয়ন চালু আছে, যারা খণ্ডকালীন গৃহকর্মীদের নিয়ে কাজ করে। সেই আওতায় পূর্ণকালীন গৃহকর্মীরা পড়েন না।

বেসরকারি সংস্থা বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালে হত্যার শিকার হয়েছেন ৩৯ জন গৃহকর্মী। যৌন নির্যাতনসহ অন্যান্য নির্যাতনের শিকার ৩৯ জন। ২০১৬ সালে ২৬ জন গৃহকর্মী হত্যার শিকার হয়েছেন। যৌন নির্যাতনসহ অন্যান্য নির্যাতনের শিকার ৪২ জন। ২০১৭ সালে হত্যার শিকার হন ২৭ জন নির্যাতনের শিকার হন ২৩ জন গৃহকর্মী। গত বছর মারা যান ১৭ জন, নির্যাতনে আহত হন ২৪ জন।

বিলসের পরিচালক নাজমা ইয়াসমিন বলেন, সংখ্যা দিয়ে আসলে নির্যাতনের বিষয়টি বিচার করা সম্ভব নয়। বেশির ভাগ নির্যাতনের ঘটনা আদালত পর্যন্ত গড়ায় না জানিয়ে তিনি বলেন, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, বিলস, ব্লাস্ট ও বিএনডব্লিউডিএ এই সংগঠনগুলো নির্যাতনের ঘটনাগুলোর তদন্ত করে। আমরা আইনি সহায়তা দেওয়ার চেষ্টা করি। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দুই পক্ষের আপস হয়ে যায়। মৃত্যুর মতো ঘটনার ক্ষেত্রেও ৬০ হাজার টাকায় মীমাংসা হয়েছে—এমন নজির আছে।