শহরে কমে গ্রামে বেড়েছে, তবে...

অলংকরণ : মাসুক হেলাল
অলংকরণ : মাসুক হেলাল

স্বামী রবিউলের সঙ্গে রংপুর থেকে ঢাকায় এসেছিলেন শেফালি বেগম। কয়েক বছর আগে ছয় হাজার টাকা বেতনে পোশাকশিল্প কারখানায় হেলপারের কাজ শুরু করেন। তবে বেশি দিন চাকরি করেননি। একমাত্র ছেলে সিয়ামের জন্য ফিরে গিয়েছিলেন। তবে চাকরির এই অভিজ্ঞতা ঠিকই কাজে লেগেছে তাঁর। উপজেলা পর্যায়ে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় সেলাই মেশিনসহ সেলাই প্রশিক্ষণ পান। দেড় বছর ধরে সেই মেশিনে গ্রামের মেয়েদের পোশাক তৈরি করে আয় করা শুরু করেছেন। এই আয়ের ওপর ভরসা করে ঋণ নিয়ে স্বামীর জন্য ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক কিনেছেন। নিজের উপার্জন থেকে মাসে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করেন।

রংপুর সদর উপজেলার উত্তর খলেয়া গ্রামের শেফালি বেগমের (৩০) সঙ্গে কথা হয় মুঠোফোনে। বললেন, সালোয়ার-কামিজ তৈরিতে নেন ১৫০ টাকা, ব্লাউজে ৪০–৫০ টাকা। আয় কেমন হয় জিজ্ঞেস করতেই বললেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ।’

শেফালির মতো অনেক নারী শহরের কাজ ছেড়ে গ্রামে ফিরে কিছু একটা করার চেষ্টা করছেন। আবার গ্রামের অনেক নারী বেতনভুক্ত বা বেতন ছাড়া যুক্ত হচ্ছেন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে। ফলে, গ্রামের শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণের পরিসংখ্যানটি ফুলেফেঁপে উঠছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যে বলা হয়েছে, এখন দেশের মোট শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণের হার শহরের চেয়ে গ্রামে বেশি। ১৯৯৫-৯৬ সালে শ্রমে নারীর অবস্থান ছিল শহরে ২০ দশমিক ৫ শতাংশ, গ্রামে ১৭ দশমিক ৪ শতাংশ। ২০০৩ সাল পর্যন্ত এ হার শহরেই বেশি ছিল। সবশেষ ২০১৬-১৭ সালে গ্রামে এ হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৮ দশমিক ৬ শতাংশে। অন্যদিকে, শহরে কমে হয়েছে ৩১ শতাংশ। গ্রামের শ্রমশক্তিতে যুক্ত নারীদের ৬০ শতাংশই রয়েছেন কৃষি খাতে।

বিবিএসের ২০১৫-১৬ সালের পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, মোট শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ ৩৫ দশমিক ৬ শতাংশ। বিভাগীয় পর্যায়ে রাজশাহী, খুলনা ও রংপুরে শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ বেশি। রাজশাহী বিভাগে সবচেয়ে বেশি ৪৯ দশমিক ৮ শতাংশ। খুলনায় ৪২ দশমিক ২ শতাংশ। রংপুরে ৪১ দশমিক ৫ শতাংশ। চট্টগ্রামে ৩৪ শতাংশ, ঢাকায় ২৯ দশমিক ৯ শতাংশ, বরিশালে ২৯ দশমিক ৮ শতাংশ এবং সিলেটে সবচেয়ে কম ২৩ দশমিক ৩ শতাংশ।

অংশগ্রহণ বেড়েছে, পরিবর্তন এসেছে কি?
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা সহযোগী মো. ইকবাল হোসেন বললেন, আগে শহরে অংশগ্রহণ বেশি হওয়ার অন্যতম কারণ ছিল পোশাক কারখানায় কাজের সুযোগ বেশি থাকা। তবে গত বছর সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা বলছে, ২০১৫ সালে পোশাকশিল্পে নারী শ্রমিকের অংশগ্রহণ ছিল ৬৪ শতাংশ, এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ৬০ দশমিক ৮ শতাংশে। নির্মাণ খাতেও নারীর সুযোগ কমেছে। এসব কারণে শহরে নারীর শ্রমে অংশগ্রহণ কমছে।

ইকবাল হোসেন বলেন, রাজশাহী ও রংপুরে নারীদের শ্রমবাজারে বেশি অংশগ্রহণের কারণ হচ্ছে দারিদ্র্য। আর খুলনায় রপ্তানিমুখী চিংড়ি খাতের প্রসারে নারী শ্রমিকের কাজের সুযোগ তৈরি হয়েছে। ফসল উৎপাদনের মতো নিজ পরিবারের আয়বর্ধক কাজে অবেতনভুক্ত নারীর অংশগ্রহণ বাড়ার কারণেও গ্রামের শ্রমশক্তিতে নারী অংশগ্রহণের হার বেড়েছে। গত দুই দশকে ১৯৯৬-২০১৭ সাল পর্যন্ত পরিবারে অবেতনভুক্ত নারীর সহায়তা করার হার ১৮ দশমিক ৫ থেকে বেড়ে ২৮ শতাংশের বেশি হয়েছে। এই অংশগ্রহণের মানে এই নয় যে গুণগত মানে পরিবর্তন এসেছে। এ ধরনের অংশগ্রহণে নারীর প্রত্যাশিত উন্নয়ন বা ক্ষমতায়ন হয় না।

শ্রমশক্তিতে অংশ নেওয়া নারীদের গুণগত মান বিষয়ে বিআইডিএসের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বলা হয়েছে, শহর এলাকায় বেতনভুক্ত কাজের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে বেশি। তবে গ্রামে অনানুষ্ঠানিক কর্মসংস্থান বা নিজস্ব কর্মসংস্থানের সুযোগ বেশি সৃষ্টি হচ্ছে। এ ছাড়া অর্থনৈতিক উন্নয়নে কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ কমে অকৃষি খাতে বেড়েছে। এরপরও নারীর মোট কর্মসংস্থানের ৬০ ভাগ জুড়ে আছে কৃষি। ৯০ শতাংশের বেশি ক্ষুদ্র ঋণ গ্রহণকারী হচ্ছেন নারী। এই ঋণের বড় একটি অংশ তাঁরা পশুর খামার ও হাঁস–মুরগি পালনে ব্যয় করেন। খামারে যুক্ত আছে ৯ দশমিক ৫ শতাংশ। এ ছাড়া ঋতুভিত্তিক ফসল উৎপাদনে ৪২ দশমিক ৩ শতাংশ যুক্ত আছে।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতি ও গ্রামীণ সমাজবিজ্ঞান অনুষদের কৃষি পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক পরেশ চন্দ্র মোদক বলেন, অর্থনৈতিক অগ্রগতির দিক দিয়ে গ্রামীণ নারীদের কেউ কেউ ভালো থাকলেও সার্বিক চিত্র তা নয়। কাজের প্রতি পুরুষের, এমনকি নারীরও দৃষ্টিভঙ্গিতে আগে পরিবর্তন আসতে হবে।

অর্থনীতিবিদ নাজনীন আহমেদের মতে, গ্রামে যে ধরনের মানদণ্ডে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে, তা ইতিবাচক। কারণ, অংশগ্রহণ ক্ষমতায়নে প্রভাব রাখে। তবে এই অংশগ্রহণ আয়বর্ধক কি না, তা দেখার বিষয়। কারণ, নারীর শ্রমবাজারে অংশগ্রহণ ও এর মাধ্যমে ক্ষমতায়নের যোগসূত্র বাংলাদেশে তত সরল নয়। গ্রামে যে অগ্রগতি হয়েছে, তাতে বিভিন্নমুখী কৃষির ভূমিকা রয়েছে। তবে এসবের অর্থনৈতিক সুবিধা পরিপূর্ণভাবে না পেলে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন পূর্ণতা পায় না। বিশেষভাবে শস্য উৎপাদনে নারীদের অংশগ্রহণ বেশি থাকলেও বিপণনব্যবস্থায় সম্পৃক্ত না হতে পারায় ক্ষমতায়নের দিক দিয়ে তাঁরা পিছিয়ে থাকেন। এ কারণে শ্রমবাজারে অংশগ্রহণের মাধ্যমে যতখানি ক্ষমতায়ন হওয়ার কথা ততখানি হয় না।

শেফালির মতো শিলা রানী (৪৫) ও তাঁর স্বামী নান্টু শিকদার গাজীপুরে পোশাকশিল্প কারখানায় কাজ করতেন। ১০ বছরের চাকরিতে অল্প অল্প করে টাকা জমিয়ে টঙ্গীর খরতৈল গ্রামে বাড়ি করেছেন। এর দুটি ঘর ভাড়া দিয়ে মাসে পান পাঁচ হাজার টাকা। শিলা রানী বলেন, ‘অনেক কষ্টে টাকা জমাইয়া বাড়ি করছি। আমার আয় বলতে ভাড়ার টাকাই। বড় মেয়েরে বিয়ে দিছি। ছোট মেয়ে এসএসসি পরীক্ষা দিছে।’

বিভিন্ন সংজ্ঞার চাপে শিলা রানী শ্রমশক্তির তালিকার বাইরে থাকলেও আয়ের এ ধরনের উৎসকে শ্রমের ফসল হিসেবে দেখতে চান অর্থনীতিবিদ নাজনীন আহমেদ। কেননা, একসময়ের শ্রমের দীর্ঘমেয়াদি ফল হিসেবে তা ক্ষমতায়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন তিনি।