নারীর রায়ে সন্তুষ্ট সবাই

গ্রাম্য সামাজিক বিচারকার্য পরিচালনা করছেন নারী কার্বারী (পাড়াপ্রধান) ক্যামেলিয়া চাকমা। সম্প্রতি রাঙামাটি সদরের ভালেদি আদামে।  ছবি: সুপ্রিয় চাকমা
গ্রাম্য সামাজিক বিচারকার্য পরিচালনা করছেন নারী কার্বারী (পাড়াপ্রধান) ক্যামেলিয়া চাকমা। সম্প্রতি রাঙামাটি সদরের ভালেদি আদামে। ছবি: সুপ্রিয় চাকমা

পাহাড়ি গ্রামের দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধ। মীমাংসার জন্য প্রার্থীরা ছুটে এলেন হেডম্যানের (মৌজাপ্রধান) কাছে। এ পদে যিনি আছেন, তিনি একজন নারী। এ নারীর রায় মেনেই সন্তুষ্ট হয়ে উভয় পক্ষকেই বাড়ি ফিরতে হয়। এই চিত্র কাল্পনিক নয় মোটেও। পার্বত্য চট্টগ্রামের সামাজিক, পারিবারিক ও ভূমি বিরোধের সমস্যাসহ নানা বিরোধের নিষ্পত্তিতে এখন নারী হেডম্যান ও কার্বারি (গ্রামপ্রধান) ভূমিকা রাখছেন।

মৌজাপ্রধান ‘হেডম্যান’ ও গ্রামপ্রধান ‘কার্বারি’ পদে পুরুষের পাশাপাশি নারীরা নিয়োগ পাওয়ায় পাহাড়ি সমাজে এমন পরিবর্তন ঘটছে। তবে পরিবর্তনের চিত্র এখনো ততটা প্রকট নয়।

পার্বত্য চট্টগ্রামে সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষা, পারিবারিক ও ব্যক্তিগত সমস্যা এবং ছোটখাটো ভূমির বিরোধ নিষ্পত্তি হয় প্রথাগত আইনের মাধ্যমে। পার্বত্য এলাকায় প্রথাগত সমাজের সর্বোচ্চ পদে আছেন সার্কেলপ্রধান বা রাজা। তাঁদের অধীনে মৌজাপ্রধান—হেডম্যান ও গ্রামপ্রধান—কার্বারিরা প্রথাগত আইনে বিচার ও সালিস পরিচালনা করেন। প্রথাগত এই বিচারপ্রক্রিয়া সরকারিভাবে স্বীকৃত। সামাজিক বিরোধ নিষ্পত্তি ছাড়াও সরকারের পক্ষে ভূমি ও জুমের খাজনা আদায়, মৌজা বন ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, স্থানীয় বাসিন্দার সনদপত্র প্রদান করতে হয় হেডম্যানদের। ছোট পরিসরে একই ধরনের কাজ করেন কার্বারিরাও।

পার্বত্য চট্টগ্রাম হেডম্যান নেটওয়ার্কের হিসাবমতে, তিন সার্কেলে ৩৮৮টি হেডম্যান পদের বিপরীতে নারী হেডম্যান রয়েছেন ১৩ জন। আর কয়েক হাজার কার্বারি পদের বিপরীতে আছেন ৫১৪ জন নারী। এর মধ্যে রাঙামাটির চাকমা সার্কেলে সাতজন, খাগড়াছড়ির মং সার্কেলে তিনজন ও বান্দরবানের বোমাং সার্কেলে তিনজন নারী হেডম্যান রয়েছেন।

পার্বত্য চট্টগ্রামে সামাজিক ও প্রথাগত কর্মকাণ্ডে নারী হেডম্যান ও কার্বারিদের প্রভাব বাড়ছে। ইতিমধ্যে তিন পার্বত্য জেলায় নারী হেডম্যান ও কার্বারিরা মিলে একটি সংগঠন গড়ে তুলেছেন। নাম দিয়েছেন সিএইচটি নারী হেডম্যান ও কার্বারি নেটওয়ার্ক।

সিএইচটি নারী হেডম্যান ও কার্বারি নেটওয়ার্কের সূত্রে জানা যায়, ২০১৩ সালে চাকমা সার্কেলের প্রদান রাজা দেবাশীষ রায়ের ঘোষণার পর নারী কার্বারি ও হেডম্যান নিয়োগ দেওয়া শুরু হয়।

নারী হেডম্যান ও কার্বারি সিএইচটি নেটওয়ার্কের সাধারণ সম্পাদক সান্ত্বনা চাকমা বলেন, ‘শুরুতে নারী হেডম্যান-কার্বারিদের তেমন গুরুত্ব দেওয়া না হলেও এখন অনেকটা গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। নারীরা নিরপেক্ষ ও দক্ষ—এমন ধারণা বাড়ছে মানুষের মধ্যে।’

নারী হেডম্যান ও কার্বারিরা বলেন, প্রতিদিন কোনো না কোনো বিষয়ে নিয়ে হেডম্যান-কার্বারিদের কাছে আসছেন গ্রামের মানুষ। কিছু বিষয় উভয় পক্ষকে বসিয়ে মীমাংসা করে দেওয়া হয়। যেসব বিষয় একটু জটিল, সেগুলো স্থানীয় পাড়াপ্রধান, জনপ্রতিনিধি ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে মীমাংসা করা হয়। যেসব এলাকায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ক্যাম্প নেই, সেসব এলাকার লোকজন তাঁদের ওপর ভরসা করেন।

রাঙামাটির বিলাইছড়ি উপজেলা বিলাইছড়ি মৌজার প্রধান বিমলী চাকমা বলেন, ‘প্রতিদিন কোনো না কোনো সময় গ্রামের লোকজন সমস্যা নিয়ে হাজির হন। আমাদের রায় উভয় পক্ষ সন্তুষ্ট মনেই মেনে নেয়। এ কারণে গ্রামে আমাদের গুরুত্বও বাড়ছে।’

সিএইচটি হেডম্যান নেটওয়ার্কের সাধারণ সম্পাদক শান্তি বিজয় চাকমার মতে, সমাজে নারীর প্রতি বৈষম্য কমাতে নারীদের মৌজা ও গ্রামপ্রধান করা হচ্ছে। নারীরা সমাজের প্রধান হওয়ায় বৈষম্য অনেকটা কমে আসছে।