জেদ থেকে জয়

জাহিদ সবুর। ছবি: সংগৃহীত
জাহিদ সবুর। ছবি: সংগৃহীত
বিশ্বখ্যাত প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান গুগলে অন্যতম প্রিন্সিপাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করছেন বাংলাদেশের তরুণ জাহিদ সবুর। বাংলাদেশের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ালেখা শেষ করে কীভাবে তিনি গুগলের অন্যতম উচ্চ পদে পৌঁছালেন? জাহিদ সবুরের সঙ্গে কথা বলেছেন মো. সাইফুল্লাহ

গুগলে আপনার কাজ সম্পর্কে যদি একটু বুঝিয়ে বলেন।

আমি শূন্য থেকে নতুন নতুন জিনিস তৈরি করতে, অর্থাৎ আবিষ্কার করতে ভালোবাসি। এখন এটাই আমার কাজ। কোডিং (প্রোগ্রামিং সংকেত লেখা) করাটা মিস করি। গত দুই-তিন বছর এক লাইনও কোড লিখিনি। কোডিং করার জন্য এখন গুগলে আমার নিজস্ব ৬০-৭০ জন প্রকৌশলীর একটা দল আছে। সাধারণত আরও বিভিন্ন টিমের কয়েক শ মানুষ আমার প্রকল্পে কাজ করে। গত বছর রিলিজ হওয়া গুগল অ্যাসিস্ট্যান্ট স্মার্ট ডিসপ্লে ছিল আমার নেতৃত্বে করা। ভাবতে অবাক লাগে, দোকান থেকে কিনে আমার বড় বোনকে যে স্মার্ট ডিসপ্লে উপহার দিয়েছি, সেটা আমারই টিমের করা। সেই প্রকল্পের ‘লিড’ হিসেবেই ‘প্রিন্সিপাল ইঞ্জিনিয়ার’ পদে পদোন্নতি পেয়েছি। এখন অ্যান্ড্রয়েড স্মার্টফোনের জন্য গুগল অ্যাসিস্ট্যান্টের নেক্সট জেনারেশন তৈরি করছি। এটা গুগলের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রকল্প।

আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ (এআইইউবি) থেকে শুরু করে গুগল। মাঝের কোন সময়টায় আপনাকে সবচেয়ে সংগ্রাম করতে হয়েছে?

সংগ্রাম করতে হয়েছিল মূলত এআইইউবিতে ঢোকারও আগে। মাধ্যমিকে, অর্থাৎ ও লেভেলে, ইংরেজি বাদে সব বিষয়ে এ গ্রেড পেয়েছিলাম। বেশ কয়েক বছর ইংরেজি মাধ্যমে পড়লেও আমার ইংরেজি খুব দুর্বল ছিল। বাংলা ছিল আমার নেশা। বড় বোনের বাংলা বইয়ের বিশাল সংগ্রহের সবটাই পড়ে ফেলেছিলাম। যাহোক, ১৫-১৬ বছর বয়সে মাথায় একটা ব্যবসার আইডিয়া আসে। খাটাখাটনি করে ব্যবসাটা বেশ দাঁড় করিয়ে ফেললেও পড়াশোনায় মন দেওয়ার সময় পাইনি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার যোগ্যতা ছিল না। রাতারাতি বড় কিছু করার চেষ্টায় জীবনে যা কিছু স্বপ্ন দেখেছিলাম, সবটাই বিলীন হয়ে যায়। বাংলার নেশায় সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ইংরেজি না শেখা, আর জীবনে শর্টকাটের খোঁজে পড়াশোনা শেষ না করেই ব্যবসা করতে যাওয়া—দুটোই আমার বড় ভুল ছিল।

সুইজারল্যান্ডের জুরিখে অবস্থিত গুগলের কার্যালয়ে কাজ করেন জাহিদ। ছবি: সংগৃহীত
সুইজারল্যান্ডের জুরিখে অবস্থিত গুগলের কার্যালয়ে কাজ করেন জাহিদ। ছবি: সংগৃহীত

সেই ভুল থেকেই শিক্ষা নিলেন?

হ্যাঁ। তখন পণ করেছিলাম, জীবনে আর কখনো শর্টকাট খুঁজব না। এআইইউবিতে পড়ার সুযোগ পেয়ে আমার জীবনের মোড় ঘুরে গিয়েছিল। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি বলে আমার খুব কাছের আত্মীয়ও মাকে কটাক্ষ করে বলেছিল, আমি নাকি মুদিদোকানে পড়ি। কথাটা বলতে তাঁর এক মুহূর্ত লেগেছে, আর তাঁকে ভুল প্রমাণ করতে আমার লেগেছে কয়েক বছর। কিন্তু ধৈর্য হারাইনি। যখনই আলসেমি ধরে বসত, সেই আত্মীয়ের কথা মনে করতাম। এরপর দ্বিগুণ উৎসাহে এগোতাম। এআইইউবিতে পড়ার সময়টা আমার খুবই প্রিয়। পড়াশোনার বাইরেও বন্ধুদের সঙ্গে খুব সুন্দর সময় কাটিয়েছি। সবচেয়ে দারুণ ব্যাপার ছিল, আমি যা শিখেছি, তার ভিত্তিতেই গ্রেড পেয়েছি। কখনো অন্ধভাবে মুখস্থ করে সময় নষ্ট করতে হয়নি। সেই সময়টা আমি প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতার পেছনে সময় দিতে পেরেছি। কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হওয়া ছিল আমার পেশা আর প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা ছিল আমার নেশা। একটা আরেকটার পরিপূরক ছিল। সব বিষয়ে এ প্লাস ছিল, তাই দ্বিতীয় সেমিস্টার থেকে শেষ পর্যন্ত পূর্ণ বৃত্তি পেয়ে পড়েছি। আর অগণিত আন্তর্জাতিক প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতায় খুবই ভালো করেছি।

প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতাই কি গুগলের পথটা সহজ করে দিয়েছিল?

এআইইউবিতে তৃতীয় বর্ষে পড়ার সময় একটা প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতার ফাইনালে গুগল আমার সাক্ষাৎকার নেয়। মাসখানেক পর, ২০০৬ সালে আমি গুগল থেকে প্রস্তাব পাই। এরপরও মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করে সিজিপিএ ৪.০০ ধরে রেখেছি, ভ্যালিডিক্টরিয়ান হিসেবে সমাবর্তন নিয়েছি। চ্যান্সেলরস অ্যাওয়ার্ড, প্রেসিডেন্টস গোল্ড মেডেল, সুম্মা কুম লাউডে—কোনোটাই বাদ পড়তে দিইনি। পরবর্তী সময়ে দেখা গেল, আমার ‘ওয়ার্ক ভিসা’ নিয়ে সমস্যা হচ্ছে। সময় নষ্ট না করে কয়েক মাস খেটে জিআরই দিয়ে আমেরিকার সেরা ১০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬টিতে আবেদন করি পিএইচডির জন্য। অনেকে হেসে বলেছিল, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি দিয়ে আমার ওসব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডাক পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আমি কিন্তু ছয়টার মধ্যে চারটাতেই ফুল ফান্ডিংসহ পিএইচডি প্রোগ্রামে ভর্তির সুযোগ পেয়ে গেলাম। আমার জিআরই স্কোর খুবই ভালো ছিল, প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতার ভালো ফলও সাহায্য করেছিল। কিন্তু এআইইউবির ডিগ্রিতে কোনো সমস্যা হয়নি। এর পরপরই গুগলে কাজ করার জন্য ভিসা পেয়ে যাই। মা-বাবার পছন্দ ছিল পিএইচডি, কিন্তু আমি গুগলে যোগ দেওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইনি।

আপনার ছেলেবেলার কথা শুনি।

মা-বাবার দেশের বাড়ি পটুয়াখালীতে। তবে আমার শৈশবের শুরুটা কেটেছে সৌদি আরবে। বাবা ড. মো. শাহজাহান সৌদি আরবের কিং ফয়সাল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক ছিলেন। মা লুৎফুন্নেসা বেগম দেশ ছাড়ার আগ পর্যন্ত ছিলেন পটুয়াখালী সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ। সাত বছর বয়সে আমি পরিবারের সঙ্গে স্থায়ীভাবে দেশে ফিরে আসি। তখন পর্যন্ত আমার শিক্ষক ছিলেন শুধুই আমার মা ও বড় বোন রীম জুন। গুগলের উদ্দেশ্যে দেশ ছাড়ার আগ পর্যন্ত ঢাকাতেই বেড়ে উঠেছি।

যত দূর জানি, আপনি শুরুতে মনিপুর হাইস্কুল ও পরে অক্সফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে পড়েছেন। সে সময় বড় হয়ে কী হওয়ার ইচ্ছা ছিল?

স্কুলজীবন শুরু হয়েছিল ক্লাস টুতে, পাড়ার কিন্ডারগার্টেন স্কুলে। মূলত আমার মায়ের কাছে তিন মাস পড়াশোনা করে বৃত্তি পরীক্ষা দিয়ে সেই ছোট্ট স্কুলের ইতিহাসে প্রথম ছাত্র হিসেবে বৃত্তি পেয়েছিলাম। সেই বয়সে তৎকালীন রাষ্ট্রপতির হাত থেকে বৃত্তির সনদ পেয়ে মনোবল বেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু পরের বছর মনিপুর উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ক্লাস থ্রিতে ১৩৩ জন ছাত্রছাত্রীর ক্লাসে ১২৭তম হলাম। তখন পড়াশোনা মানেই ছিল মুখস্থ করা। আমি একদমই মুখস্থ করতে চাইতাম না। আমার মনে হতো, তাতে নতুন কিছুই শেখা হচ্ছে না। পরে মা আমাকে অক্সফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। তখন আমার সবচেয়ে পছন্দের জিনিস ছিল ইলেকট্রনিকস। স্বপ্ন দেখতাম, বড় হয়ে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হব। তখন থেকেই টুকটাক সার্কিট বানাতে শুরু করলাম। পড়াশোনা না করে এই সব করতে দেখেও মা আমাকে কখনো বাধা দেননি। বরং তিনিই আমাকে প্রয়োজনীয় ইলেকট্রনিকসের টুকিটাকি খুঁজতে স্টেডিয়াম মার্কেটে নিয়ে যেতেন। আমার বয়স তখন সবে ১০ হয়েছে। এরপর বিজ্ঞান মেলাতে অংশগ্রহণ করে কখনো দ্বিতীয় হইনি। এই সবই সম্ভব হয়েছিল শুধু মায়ের কারণে।

মায়ের সঙ্গে জাহিদ সবুর, মায়ের প্রেরণাতেই ছোটবেলায় বিভিন্ন বিজ্ঞান মেলায় অংশ নিতেন তিনি
মায়ের সঙ্গে জাহিদ সবুর, মায়ের প্রেরণাতেই ছোটবেলায় বিভিন্ন বিজ্ঞান মেলায় অংশ নিতেন তিনি

গুগলে কবে থেকে কাজ শুরু করলেন? শুরুতে কোন পদে যোগ দিয়েছিলেন? যত বছর কাজ করলেন, এর মধ্যে কোন দিনটা সবচেয়ে বিশেষ?

২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে এআইইউবি থেকে সমাবর্তন নিয়ে মার্চে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে প্রথম সরসরি গুগলে যোগ দিই সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে। আমার সিনিয়র কিছু বাংলাদেশি ভাইয়ারা প্রথমে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর ডিগ্রি শেষ করে আমার পরে গুগলের সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হয়েছেন। শুরুতে সবার মতোই আমার ‘জব লেভেল’ ছিল ৩। পিএইচডি থাকলে সরাসরি লেভেল ৪ পাওয়া যেত, অতটুকুই পার্থক্য। গুগলের বেশির ভাগ ইঞ্জিনিয়ার লেভেল ৬ বা তার আগেই অবসর নেবে। তাই যখন লেভেল ৭ হলাম, ওটাই বিশাল ব্যাপার ছিল, এর চেয়ে বেশি অসম্ভব মনে হয়েছে। গুগলে প্রায় ১ লাখ ফুলটাইম কর্মীর মধ্যে মাত্র ২৫০ জনের মতো প্রিন্সিপাল ইঞ্জিনিয়ার আছেন, যা কি না লেভেল ৮ এবং পরিচালক পদ। কখনো ভাবিনি কোনো বাংলাদেশি এই তালিকায় থাকবে। তাই যখন আমিই প্রথম প্রিন্সিপাল ইঞ্জিনিয়ার এবং একমাত্র বাংলাদেশি পরিচালক হয়ে গেলাম, সেটাই ছিল সবচেয়ে বিশেষ দিন।

ফেসবুকে আপনার প্রোফাইল দেখে মনে হলো, খেলাধুলা ও ফিটনেসের প্রতিও আপনার আগ্রহ আছে। এই আগ্রহ কি আপনাকে এগিয়ে রেখেছে?

নিশ্চয়ই। আমি যে অবস্থানে পৌঁছেছি, তার পেছনে ব্যাডমিন্টনের বিশাল অবদান আছে। ফেসবুকে প্রায়ই আমি খেলাধুলা ও ফিটনেস নিয়ে আমার অভিজ্ঞতা শেয়ার করার চেষ্টা করি। এই ছোট্ট একটা জিনিস আমার জীবন অদ্ভুতভাবে বদলে দিয়েছে।

বাংলাদেশের শিক্ষার্থী, তরুণদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?
জীবনে শর্টকাট পথ খুঁজে বা ইংরেজিকে হেলা করে পিছিয়ে যেয়ো না। কঠোর পরিশ্রম ও দৃঢ় সংকল্প—এই দুইয়ের চেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার আমার জানা নেই। আজ তুমি যা-ই হও না কেন, কাল যেন আগের চেয়ে একটু হলেও এগিয়ে থাকো। জীবনে কোনো ব্যর্থতাকেই খুব বড়, আর কোনো সুযোগকেই খুব ছোট মনে কোরো না। জীবনকে তোমার সেরাটা দিয়ে যাও, সাফল্য একদিন আসবেই।