ছাদ নাকি আকাশ কোনটা ছোঁবে?

সুবীর চৌধুরী
সুবীর চৌধুরী
চট্টগ্রাম সরকারি হাইস্কুলের ছাত্র ছিলেন সুবীর চৌধুরী। এখন তিনি কোয়ালিটি বা গুণগত মান বাড়াতে পরামর্শ দেন বড় বড় প্রতিষ্ঠানকে। তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ম্যানেজমেন্ট কনসালট্যান্ট বা ব্যবস্থাপনা পরামর্শকদের একজন। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর নামে ফেলোশিপ আছে, তাঁর নামে ফেলোশিপ আছে লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসেও। ৪ মে যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল মিশিগান ইউনিভার্সিটির সমাবর্তনে বক্তা ছিলেন তিনি।

শুভ সকাল। এই সেই সেন্ট্রাল মিশিগান ইউনিভার্সিটি। যেখানে এসে আমি অফুরন্ত জীবনীশক্তি পাই!

এ দেশে পা রেখে আমার প্রথম রাতটি কেটেছিল মিশিগানের মাউন্ট প্লেজেন্ট শহরে। আমার বিমান যাত্রা বাংলাদেশ থেকে সরাসরি মিশিগানে ছিল না। কিছু খরচ বাঁচাতে আমি একটা ভিন্ন পথ বেছে নিয়েছিলাম। প্রথমে গিয়েছিলাম থাইল্যান্ড। এরপর তাইওয়ান, সিয়াটেল, ডেট্রয়েট হয়ে সবশেষে নেমেছিলাম ল্যান্সিংয়ে। ওখানে নেমে একটা গাড়ি ভাড়া করে চলে এসেছিলাম মাউন্ট প্লেজেন্ট; আমার ইউনিভার্সিটি সেন্ট্রাল মিশিগানে।

সেটি ১৯৯১ সালের আগস্ট মাস। আমার হাতে তেমন কোনো টাকাপয়সা ছিল না। এ দেশে এসেছি মাস্টার্স করতে। সেন্ট্রাল মিশিগান ইউনিভার্সিটির এক ডিপার্টমেন্টে আমার ডাক পড়েছে। স্কলারশিপসহ ফেলোশিপের অফার। আমাকে বলা হয়েছিল দুই সপ্তাহ আগেই আমেরিকা চলে আসতে। আমি দুই সপ্তাহের জায়গায় তিন সপ্তাহ আগে এসে উপস্থিত হলাম। আমার অধ্যাপককে খুশি করতে।

ঘরে কোনোরকমে ব্যাগ-ব্যাগেজ ফেলে ছুট লাগালাম অধ্যাপকের খোঁজে। তিনি আমাকে দেখে যেন চমকে গেলেন। বললেন, ‘তোমার না পরের সপ্তাহে আসার কথা?’ আমি বললাম, ‘জি স্যার, আমি এক সপ্তাহ আগেই চলে এসেছি; আপনি খুশি হবেন ভেবে!’ তিনি কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে চেয়ে রইলেন। বললেন, ‘দুঃখিত সুবীর, আমি ফেলোশিপের জন্য আরেকজনকে সিলেক্ট করে ফেলেছি!’

আমি হতভম্ব। কেঁদেই ফেললাম। প্রায় চিৎকার করে বললাম, ‘স্যার, আপনি এ কাজ করতে পারেন না!’ কোনো লাভ হলো না। আমি স্কলারশিপ পেলাম না।

পরদিন কিছু প্রবাসী শিক্ষার্থী আমার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল। তারা আমার অসহায়ত্ব অনুভব করল। পরামর্শ দিল, ক্যাম্পাসের বাইরে একটা চাকরি খুঁজে নেওয়ার। কিন্তু আমার ওয়ার্ক ভিসা নেই। ক্যাম্পাসের বাইরে চাকরি আমার জন্য বেআইনি। আমি এ দেশে এসেছি স্টুডেন্ট ভিসায়; কিন্তু কোর্স রেজিস্ট্রেশন করার মতো টাকা নেই!

এবার আমি ঘুরতে লাগলাম ইউনিভার্সিটির ডিপার্টমেন্টগুলোতে। খুঁজতে লাগলাম স্কলারশিপের সুযোগ। সমাজবিজ্ঞান, সাংবাদিকতা, এমনকি ইংরেজি বিভাগেও ঢুঁ মেরে এলাম। তাদের বোঝাতে চেষ্টা করলাম, আমার ইংরেজিতে ভালো দখল আছে। এভাবে প্রায় সব ডিপার্টমেন্ট ঘুরলাম। শেষ মুহূর্তে কড়া নাড়লাম গণিত বিভাগের দরজায়! চেয়ারম্যান ড. রিচার্ড ফ্লেমিং আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। বললেন, ‘তুমি এরই মধ্যে ২০টি ডিপার্টমেন্ট ঘুরে ফেলেছ। ওরা সবাই তোমাকে ফিরিয়ে দিয়েছে। এবার যদি আমিও তোমাকে নিরাশ করি, তুমি কী করবে?’ আমি বললাম, ‘২২তম ডিপার্টমেন্টের দরজায় গিয়ে উপস্থিত হব।’ রিচার্ড সাহেব বললেন, ‘তুমি পলিমার বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করতে পারবে?’ আমি জানালাম, ‘খড়গপুরের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি থেকে অ্যারোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে আমি পাস করে বেরিয়েছি। যেকোনো বিষয়েই আমি মাস্টার্স করতে পারব।’

তিনি আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ করে দিলেন। পেয়ে গেলাম ডোউ ফেলোশিপ। এর জন্য আমি সারা জীবন ড. লীলা রাকেশের কাছে কৃতজ্ঞ থাকব। তিনি আজকের অনুষ্ঠানে উপস্থিত আছেন।

ডোউ ফেলোশিপ দিয়ে আমার সব পড়াশোনার খরচ জুটে গেল। ১৯৯৩ সালে আমি স্নাতক হলাম। পেলাম বেস্ট থিসিস অ্যাওয়ার্ড। সব কটি গ্র্যাজুয়েট স্কুলের ভেতর আমার থিসিস হলো সবচেয়ে সেরা।

আমার অধ্যাপকেরা তখন চেয়েছিলেন আমি পিএইচডির জন্য লেগে পড়ি। কিন্তু আমার পরিকল্পনা ছিল ভিন্ন। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে পড়লাম। লক্ষ্য—নিজের ক্ষেত্রে সেরা হওয়া। একজন ব্যবস্থাপনা-বিশেষজ্ঞ হওয়া। বিশ্বের নামকরা প্রতিষ্ঠানগুলোকে কোয়ালিটি বা গুণগত মানবিষয়ক পরামর্শ দেওয়াই যার কাজ।

আমার অধ্যাপকেরা আশাহত হলেন। আমি তাঁদের চিন্তা করতে মানা করলাম, বললাম, ‘একদিন দেখবেন সেন্ট্রাল মিশিগান ইউনিভার্সিটিই আমাকে ডেকে নিয়ে অনারারি ডক্টরেট দেবে।’

আজ সে কথা সত্য হলো।

আমি তোমাদের আমার জীবনের কিছু গল্প শোনাতে চাই। সেগুলো তোমাদের সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করবে। আজ থেকে তোমরা যে সিদ্ধান্ত নেবে, সেটাই পরে তোমার ও তোমাদের আশপাশের সবার জীবনকে সাজিয়ে দেবে।

যেহেতু আমি তোমাদের চেয়ে বয়সে বড়, তাই আমার অভিজ্ঞতাও তোমাদের চেয়ে বেশি। আর এই অভিজ্ঞতাগুলো তোমাদের জীবন গঠনে কাজে লাগবে বলে আমি বিশ্বাস করি। আমি এখন বিশ্বের বড় কোম্পানিগুলোকে পণ্য বা অন্যান্য বিবিধ বিষয়ে পরামর্শ দিই। এতে তাদের গুণগত মান নিশ্চিত হয়। এটাই আমার ব্যবসা। যখন সিএমইউয়ের শিক্ষার্থী ছিলাম, এ ব্যবসা সম্বন্ধে আমার কোনো ধারণা ছিল না। ব্যবসাজগতে এই ‘কোয়ালিটি’ শব্দটির একটি বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। আমি সে সময় তা জানতাম না।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় অধ্যাপকদের একটা ক্লাবে যোগ দিয়েছিলাম। নাম আমেরিকান সোসাইটি ফর কোয়ালিটি। এর সদস্য হতে লেগেছিল ১০ ডলার! ওখান থেকেই ব্যবসা-বাণিজ্যে কোয়ালিটির এই ক্ষেত্র সম্পর্কে জানতে পারি। গ্র্যাজুয়েশনের পর অধ্যাপকদের বলেছিলাম, ‘একদিন দেখবেন আমেরিকার সেরা সব বাণিজ্য বিভাগে আমার লেখা বই পড়ানো হবে।’

সমাবর্তনে বক্তৃতা দিচ্ছেন সুবীর চৌধুরী। ছবি: ইউটিউব থেকে নেওয়া
সমাবর্তনে বক্তৃতা দিচ্ছেন সুবীর চৌধুরী। ছবি: ইউটিউব থেকে নেওয়া

কথাটা তখন উদ্ধত শোনালেও আজ তা বাস্তব হয়েছে। গ্র্যাজুয়েশনের পাঁচ বছর পর আমার লেখা কোয়ালিটিবিষয়ক বইগুলো বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আর আমি ১০ বছরের মধ্যেই কোয়ালিটি বিষয়ে বিশ্বের সেরা বিশেষজ্ঞদের তালিকায় স্থান পেয়েছি। তবু আজ উচ্চশিক্ষায় সর্বোচ্চ দুটো ডিগ্রি হাতে নিয়ে বলব: এখনো অনেক কিছুই শেখার বাকি।

এখন সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে আমরা বেশির ভাগ সময় যন্ত্র নিয়েই পড়ে থাকি। পরিবার-পরিজনদের সঙ্গে কদাচিৎ সময় কাটাই। কিন্তু যখন ছোট ছিলাম, আমাদের কম্পিউটার ছিল না; আইফোন ছিল না। আমার ছেলেবেলা কেটেছে দাদা-দাদির সঙ্গে। এর জন্য আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি! আমার জীবনে দাদা ছিলেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তিনি বিশ্বের একটি দরিদ্রতম দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। কিন্তু জ্ঞানবিচারে তিনি ছিলেন সমৃদ্ধ।

তিনি সব সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে জোর দিতেন। প্রায়ই বলতেন, ‘সুবীর, বলো তো কোন সংখ্যাটি সবচেয়ে বেশি ক্ষমতাশীল? ০ নাকি ৯?’ আমার বয়স তখন ৫ বছর। আমি স্বভাবতই ৯-কে বেছে নিতাম। আর তিনি বলতেন, ‘নাহ, শূন্যই সবচেয়ে শক্তিশালী। শূন্যের একার কোনো মূল্য নেই বটে। কিন্তু এর আগে অন্য কোনো সংখ্যা জুড়ে দাও, দেখবে শূন্যের মূল্য দ্রুত বেড়ে গেছে।’

স্নাতকেরা, মনে রাখবে, তোমরা একেকজন সেই শূন্যের মতো। যখন তোমরা সবাই মিলে কাজ করবে, তখনই সেই কাজ পূর্ণতা পাবে। জীবনে বড় হবে। জগতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারবে। তখন কিন্তু বড় হওয়ার পেছনে যাঁদের অবদান, তাঁদের কথা ভোলা যাবে না।

স্নাতকদের জন্য আমার প্রথম উপদেশ, শূন্য থেকে শেখো। যখন বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়েছিলাম, দাদার কথা প্রায়ই মনে করতাম। তিনি বলতেন, ‘দাদু, যদি বলি ছাদ ছোঁবে নাকি আকাশ ছোঁবে? কোনটি বেছে নেবে?’

আমি ছেলেমানুষ। বলতাম, ‘সে তো সহজ হিসাব। আমি ছাদ ছোঁব।’

দাদু মাথা নেড়ে বলতেন, ‘উঁহু, সব সময় আকাশ ছোঁবার চেষ্টা করবে।’

আমি অবাক হয়ে এর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলতেন, ‘ছাদ ছোঁয়া অতি সহজ কাজ। সেটা যে কেউ পারে। তোমার যদি লক্ষ্য থাকে আকাশ ছোঁয়ার, তবে জীবনে বহুদূর যেতে পারবে।’

স্নাতকেরা, জীবনে এক পা, দুপা করে অনেক দূর যেতে হবে। নিজের ক্ষমতার বাইরে গিয়েও চেষ্টা করতে হবে। ছাদ ছোঁয়া সহজ। তাই সেটুকু করেই বসে থাকা চলবে না। ছাদ ছাপিয়ে আকাশের দিকে হাত বাড়াতে হবে। সমাজ, পরিবার, চাকরি—সবক্ষেত্রেই ইতিবাচক অবদান রাখার জন্য নিজের সবটুকু ঢেলে দিতে হবে। তবেই সাফল্য আসবে।

এখন তোমাদের সর্বশেষ গল্পটি শোনাব। সেটিও আমার দাদাকে নিয়েই। এক দিন তিনি আমার হাতে একটা কলম ও একটি মুদ্রা দিয়ে বললেন, ‘সুবীর, কোনটি নেবে, বলো?’

আমি মুদ্রাটি তুলে নিলাম। কারণ সেটি নিয়ে দোকানে গেলেই কিছু না কিছু কেনা যায়। কিন্তু দাদার উপদেশে কলমকেই বেছে নিতে হলো। তিনি বললেন, ‘কলম দিয়ে তুমি জগৎ বদলে দিতে পারবে। মুদ্রা দিয়ে খেলনা কেনা যায়, চকলেট কেনা যায়। কিন্তু কিছু না কিছু কিনলেই মুদ্রা ফুরিয়ে যায়। অন্যদিকে কলম দিয়ে তুমি লিখতে পারবে, আঁকতে পারবে, সেটাকে সৃষ্টিশীল কাজে লাগাতে পারবে। একদিন হয়তো কেউ তোমার কাজের মূল্যায়ন করবে। আর তোমার কাজ সমাদৃত হলেই টাকা আপনা-আপনি তোমার পকেটে চলে আসবে।’ কথাগুলো সরল, কিন্তু অত্যন্ত জ্ঞানগর্ভ।

ছেলেবেলায় আমি বিভিন্ন নামকরা ব্যক্তিদের কাছে চিঠি লিখতাম। যাঁদের কাজ আমাকে অনুপ্রেরণা জোগাত। তাঁদের অনেকেই আমার চিঠির উত্তর দিতেন। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ পরে আমার জীবনে মেন্টর হয়ে উঠেছিলেন। এখনো বড় হয়ে আমি লেখালিখি করি। লেখার মাধ্যমে আমার চিন্তাধারা প্রকাশ করি। এভাবেই ইতিবাচক পরিবর্তনের পক্ষে আমি কাজ করে যেতে চাই। গড়ে তুলতে চাই আরও সুন্দর একটু পৃথিবী।

স্নাতকদের বলছি, তোমরা কলম বেছে নাও। নিজের সৃষ্টিশীলতা ঝালাই করো। এতে পরিবর্তন আসবে। কলম ব্যবহার করেই জগতের জন্য মঙ্গলজনক উদ্যোগ নাও। কারণ এটি অর্থের চেয়েও মূল্যবান।

আমি আর সময় নেব না। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার বক্তব্য শেষ করছি। যাওয়ার কালে আমার লেখা একটি বই তোমাদের উপহার দিয়ে যেতে চাই। সেটি সাম্প্রতিক প্রকাশ পেয়েছে। নাম দ্য ডিফারেন্স। ওতে আমার জীবনের কিছু গল্প আছে। আশা করি, বইটি তোমাদের অনুপ্রাণিত করবে। যেমনিভাবে আমার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা, আমার পরিবার ও বন্ধুরা এবং আমার সহকর্মী ও ক্লায়েন্টরা আমাকে অনুপ্রাণিত করেছেন।

২০১৯ সালের গ্র্যাজুয়েশনপ্রাপ্ত স্নাতকদের অভিনন্দন জানাই। আমাকে সম্মাননা দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। (সংক্ষেপিত)

ইংরেজি থেকে অনুবাদ: শাহরোজা নাহরিন