ঢাকায় যৌতুকের কারণে বছরে হত্যা ২২ নারী

দেয়ালের সঙ্গে ধাক্কা দিয়ে মাথা ফাটিয়ে ফারজানা আক্তারকে তাঁর স্বামী হত্যা করেছেন বলে অভিযোগ ওঠে। গত ২৬ এপ্রিল রাজধানীর কাফরুলে ঘটা এ ঘটনায় ফারজানার পরিবার ফারজানার স্বামীসহ চারজনের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেছে। আদালতের নথি বলছে, ব্যবসা করার জন্য ৩০ লাখ টাকা যৌতুক চেয়েছিলেন ফারজানার স্বামী। তা দিতে না পারায় ফারজানার এ পরিণতি।

ফারজানা হত্যার চার দিন আগে রাজধানীর হাজারীবাগে মুনা আক্তার নামের আরেক নারীকে যৌতুকের কারণে হত্যার অভিযোগে মামলা হয়।

প্রথম আলোর অনুসন্ধানে ঢাকার আদালতের বিচারিক নিবন্ধন খাতার হিসাব অনুযায়ী, গত ১৭ বছরে ঢাকায় ৩৭৪ জন নারীকে যৌতুকের জন্য হত্যা করা হয়েছে। প্রতিবছর ঢাকায় যৌতুকের জন্য গড়ে ২২ নারীকে হত্যা করা হচ্ছে। ঢাকা মহানগর এলাকায় গত এক বছরে যৌতুকের জন্য ১৪ জন নারী হত্যার শিকার হন।

ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৩–এর সরকারি কৌঁসুলি মাহমুদা আক্তার বললেন, যৌতুকের জন্য নির্যাতনের অভিযোগে প্রায় প্রতিদিন তাঁর আদালতে মামলা হচ্ছে। থানায় করা মামলার তদন্ত প্রতিবেদনও আদালতে পাঠানো হচ্ছে। যৌতুকের জন্য নির্যাতন করে হত্যার কয়েকটি মামলাও তাঁর আদালতে বিচারাধীন।

যৌতুকের জন্য হত্যা
ঢাকায় যৌতুকের কারণে হত্যার কয়েকটি ঘটনার অভিযোগ পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, ভুক্তভোগী নারীর স্বামী এবং তাঁর পরিবারের সদস্যরা নানাভাবে নির্যাতন করে খুন করলেও খুনের ঘটনাকে আত্মহত্যা বা অসুস্থতা বলে চালানোর চেষ্টা করা হয়।
কাফরুলের ফারজানা হত্যার ঘটনাটি তেমনই। মামলার নথিতে দেখা যায়, ১০ বছর আগে ১৫ বছর বয়সী ফারজানা আক্তারের সঙ্গে কামরুল হাসান ভূঁইয়ার বিয়ে হয়। ব্যবসা করার জন্য যৌতুকের জন্য চাপ দিতে থাকেন স্বামী।
মামলার বাদী ফারজানার মামা হাবিব উল্লাহ বললেন, ‘জমি বিক্রি করে দোকান করার জন্য টাকা দেওয়া হয়েছিল কামরুলকে। এরপর আরও চাইত। ঘটনার দিন দেয়ালের সঙ্গে ধাক্কা দিয়ে ফারজানার মাথা ফাটিয়ে হত্যা করা হয়। অথচ আমাদের ফোন করে বলা হয়, ফারজানা স্ট্রোক করে মারা গেছে।’

গত ২২ এপ্রিলে মুনা আক্তার হত্যায় আদালতকে দেওয়া পুলিশের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হাজারীবাগের পারভেজের সঙ্গে সাত-আট মাস আগে মুনার বিয়ে হয়। বিয়ের পর থেকে যৌতুকের চার লাখ টাকা এনে দেওয়ার জন্য মুনাকে চাপ দিতেন স্বামী। ঘটনার দিন মুনাকে লোহার পাইপ দিয়ে পিটিয়ে প্রথমে জখম করা হয়। পরে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়।

গত বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর ঢাকার কল্যাণপুরে ফারজানা আক্তার নামের আরেক নারীর খুনের ঘটনায় আদালতে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। এতে বলা হয়েছে, ফারজানাকে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়। পিবিআই এ ঘটনায় স্বামী শফিকুল ইসলামকে গত ১০ এপ্রিল ঢাকার আদালতে পাঠায়। মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, দুই লাখ টাকা যৌতুকের কারণে প্রায়ই ফারজানাকে নির্যাতন করতেন স্বামী।

চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় গত বছরের ১৫ জুন খিলগাঁওয়ে খুন হন নাসিমা। স্বামী অহিদুল ইসলাম যৌতুকের কারণে তাঁকে পিটিয়ে হত্যা করেন বলে মামলার এজাহারে বলা হয়েছে।

>

১৭ বছরে ঢাকায় ৩৭৪ জন নারীকে যৌতুকের জন্য হত্যা করা হয়েছে
ঢাকা মহানগর এলাকায় গত এক বছরে ১৪ জন নারী হত্যার শিকার হন

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের (ওসিসি) আইনজীবী ফাহমিদা আক্তার বললেন, যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার নারীরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসেন। চিকিৎসা নিতে আসা নারীদের মধ্যে দেখা যায়, যৌতুকের কারণে কারও গায়ে আগুন দেওয়া হয়েছে, কাউকে পিটিয়ে হাত-পা ভেঙে দেওয়া হয়েছে।

সাজা মাত্র ৩ শতাংশ
ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারিক নিবন্ধন খাতার তথ্য বলছে, ঢাকায় ২০১৬ সালে ২৭ জন, ২০১৫ সালে ২৫ জন, ২০১৪ সালে ২২ জন, ২০১৩ সালে ৩০ জন, ২০১২ সালে ২৫ জন, ২০১১ সালে ২৬ জন এবং ২০১০ সালে ১৫ জন নারীকে যৌতুকের জন্য নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। তবে যৌতুকের কারণে ঢাকায় যে হারে নারীরা হত্যার শিকার হচ্ছেন, সে অনুপাতে সাজার হার খুব কম। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারিক নিবন্ধন খাতার তথ্য বলছে, ২০০২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত নিষ্পত্তি হওয়া যৌতুকের জন্য হত্যা মামলার মাত্র ৩ শতাংশের সাজা হয়েছে।

ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের সাবেক সরকারি কৌঁসুলি ফারুক আহম্মেদ বললেন, যৌতুকের কারণে হত্যার ঘটনাকে আত্মহত্যা বলে চালানোর জোর চেষ্টা থাকে আসামিপক্ষের।
বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সাবেক নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী বললেন, যৌতুকের মামলাগুলো ভালোভাবে তদন্ত করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে হবে। ট্রাইব্যুনালে দক্ষ সরকারি কৌঁসুলি দরকার। সালমা আলীর মতে, যৌতুক বন্ধে আইনের সঠিক প্রয়োগ করতে হবে। রাষ্ট্রকে নির্যাতনের শিকার নারীর পাশে দাঁড়াতে হবে। যৌতুকের জন্য নির্যাতনকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।