কারাতে-জুডোতে উজ্জ্বল মারুফা

মারুফা খাতুন যেন পাহাড়সম প্রতিবন্ধকতা জয়ের সুন্দরতম এক উদাহরণ। তাঁর বাবা ছিলেন ফুটপাতের দোকানি। টানাটানির সংসারে মারুফার স্বপ্ন ছিল কারাতে শেখার। কিন্তু ভর্তি ফি ৩০০ টাকা জোগাতেই হিমশিম খেতে হয়েছিল। তবে তাঁর অদম্য ইচ্ছা দেখে বিনে পয়সায় ভর্তি করান প্রশিক্ষক। নিতান্তই লাজুক আর ছিঁচকাঁদুনে মেয়েটি একদিন কুস্তিতে অনেককে হার মানাবেন, এ কথা কারও ভাবনায় ছিল? রাজশাহীর সেই অদম্য মারুফা খাতুন এখন ‘স্বর্ণজয়ী মারুফা’। জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে কারাতেসহ জুডো, উশু, কুস্তিতে ১৫টি স্বর্ণপদক পেয়েছেন।

তবে এই সাফল্যের পথে বারবার হোঁচট খেয়েছেন, দারিদ্র্য জেঁকে বসেছে, মানুষের অসহযোগিতা, কালো মুখ দেখেছেন। কিন্তু তাঁকে দমিয়ে রাখা যায়নি, আপন উজ্জ্বলতায় উদ্ভাসিত হয়েছেন, জয় করেছেন স্বর্ণপদক, পাশাপাশি চালিয়ে নিয়েছেন পড়াশোনা। বিয়ে করেছেন। রাজশাহীতে স্বামী-স্ত্রী মিলে পরিচালনা করছেন বেঙ্গল মার্শাল আর্ট একাডেমি। কয়েক শ শিক্ষার্থী এখন প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন মারুফাদের কাছে, যাঁদের অনেকের স্বপ্নই উজ্জ্বল করে তুলছে মারুফার হার না–মানা গল্প।

সাথি দেখিয়েছিল পথ

২০০৪ সালের কথা। রাজশাহী নগরের আসাম কলোনিতে ছিল মারুফাদের বাসা। সেই কলোনিতেই থাকত সাথি নামের একটি মেয়ে। সাথি ভর্তি হয়েছিল কারাতে কোর্সে। সাথিই পথ দেখিয়েছিল মারুফাকে কারাতে শিখতে। মারুফার মা নাজমা বেগম শুনেছিলেন, কারাতে শিখলে চাকরি মেলে। তাই মেয়েকে পাঠিয়েছিলেন শিখতে। ভর্তি হতে চাইলেই তো ভর্তি হওয়া যায় না। বাদ সাধল ভর্তি ফি আর মাসিক বেতন। এই বাড়তি টাকা পাবে কোথায়। ঠিক তখনই ওস্তাদ আহসান কবির ও ওয়াসিম আলীর নজর কাড়ল মারুফার নৈপুণ্য। ভর্তি করালেন বিনে পয়সায়।

মারুফার বয়স এখন ২৫ বছর। শৈশবের কথা বলতে গিয়ে একেবারে শিশুর মতোই হয়ে গেলেন। মারুফা বলছিলেন, ‘সে সময় (২০০৪ সাল) ভর্তির তিন-চার মাস পরই একটি টুর্নামেন্ট ছিল। আমাকে অংশ নিতে হবে জেনে খুব ভয় হচ্ছিল, যদি ব্যথা পাই।’ সেই টুর্নামেন্টে আহত হননি মারুফা। ভয়ও কিছুটা কেটে গেল। ২০০৫ সালে আরেকটা টুর্নামেন্ট ছিল। মারুফা বলে যান, ‘তখন আমার ওজন ৩৬ কেজি। আর প্রতিযোগী ছিল ৮০ থেকে ৯০ কেজি ওজনের। ছেলেরাও ছিল। সবার সঙ্গে লড়াই করে জিতে যাই।’

সেই শুরু হলো মারুফার জয়যাত্রা। রাজশাহী স্টেডিয়ামে আন্তজেলা টুর্নামেন্টে স্বর্ণপদক পেয়ে গেলেন। দুই বছরের মধ্যে ২০০৭ সালে জুডোতে জাতীয় পর্যায়ে স্বর্ণপদক পেলেন। নির্বাচিত হলেন শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়ও।

স্কুল ছাড়েননি মারুফা

গল্পের মোড় ঘুরিয়ে মারুফা বললেন, ‘খেলায় মন দিলেও আমি পড়াশোনা ছাড়িনি।’ যদিও তাঁর অন্যদের মতো প্রাইভেট পড়ার সামর্থ্য ছিল না। ছিল না স্কুল ড্রেসও। এ জন্য প্রায়ই শিক্ষকের বকাও খেতে হয়েছে। আর স্কুলে গিয়ে টিফিনে খাওয়া তো ছিল অকল্পনীয় ব্যাপার। তবু স্কুল শেষে বাড়ি ফিরেই দৌড় দিতেন অনুশীলনে।

মারুফা বলে যান, ‘২০০৯ সালে রাজশাহী নগরের শিরোইল কলোনি উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিলাম। পরীক্ষার মধ্যেও কারাতে প্রতিযোগিতায় অংশ নিলাম। এ খেলাতেও স্বর্ণপদক পেলাম।’ সে বছরই ভারতে জুডো প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে রৌপ্যপদক পান মারুফা।

মারুফা খাতুন। ছবি: মাসুদুল হক
মারুফা খাতুন। ছবি: মাসুদুল হক

ভালো খেলার সুবাদে ২০১০ সালে আনসার বাহিনী মারুফাকে চাকরির সুযোগ দেয়। একই বছর সরকারি খরচে প্রশিক্ষণের সুযোগ পান থাইল্যান্ডে। এই আনন্দের মধ্যেও মারুফার জীবনে নেমে এল হাহাকার। বলতে বলতে মারুফার চোখ ভিজে ওঠে, ‘প্রশিক্ষণ শেষে বিমানবন্দরে নেমেই বাবাকে ফোন দিলাম। বাবা ফোন ধরলেন না। ব্যাকও করলেন না। আমার সব আনন্দ যেন মাটি হয়ে গেল। ভীষণ মন খারাপ নিয়ে বাড়ি ফিরে শুনলাম বাবা আরেকটা বিয়ে করে বাড়ি থেকে চলে গেছেন।’

সব যেন আবার গোড়া থেকে শুরু করতে হলো তাঁকে। কারণ, সংসারে রোজগারের দ্বিতীয় কেউ নেই। সংসার নতুন করে সাজাতে গিয়েও ভেঙে পড়েননি মারুফা। এর মধ্যে পড়াশোনাও চালিয়ে যান। উচ্চমাধ্যমিক পাসের পর স্নাতকে ভর্তি হন স্থানীয় কলেজে। স্নাতকে পড়ার সময়ই ২০১৩ সালে বাংলাদেশ গেমসে জুডোতে স্বর্ণপদক পান। ওই বছরই যেন তাঁর জন্য স্বর্ণবছর! মোট পাঁচটি স্বর্ণ পেয়েছিলেন সে বছর। সব মিলিয়ে তাঁর ঝুলিতে এখন ১৫টি স্বর্ণপদক।

একই বছর বিয়ের পিঁড়িতে বসেন মারুফা। স্বামী দস্তগীর আবদুল্লাহ। তিনিও মার্শাল আর্টে ব্ল্যাক বেল্ট ফোর্থ ড্যান (এইচএসকেএ)। মারুফার ভাষায়, ‘তিনি খুব ভালো মনের মানুষ।’ তাঁর সহযোগিতার কারণে দুটি সন্তান হওয়ার পরও তিনি বেঙ্গল মার্শাল আর্ট একাডেমিতে নিয়মিত অনুশীলন করতে পারছেন। প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন নবীনদের। সেই সঙ্গে স্নাতক সম্পন্ন করে বর্তমানে এমবিএ করছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে।

স্বপ্ন ছড়ানো বেঙ্গল মার্শাল আর্ট

মারুফাদের বেঙ্গল মার্শাল আর্ট স্কুলটি রাজশাহীর বোয়ালিয়ায়। নগরীর অনেক ছেলেমেয়ে এখানে আসেন প্রশিক্ষণ নিতে। তাঁদের জন্য মারুফার স্লোগান হচ্ছে, ‘সুস্থ শরীর, সুন্দর চিন্তা।’ তিনি মনে করেন, নিজের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও নিজেকে আত্মবিশ্বাসী একজন মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সব শিশুর মার্শাল আর্ট অনুশীলনের প্রয়োজন রয়েছে। এর মাধ্যমে একদিকে সুস্থ শরীর গঠন, মেধার বিকাশ ও কর্মক্ষমতা বাড়বে। এতে করে আাগামী দিনে একজন মানুষ যার যার নিজের জায়গায় আরও বেশি ভূমিকা রাখতে পারবে। মারুফা স্বপ্ন দেখেন, সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন মার্শাল আর্টের অনুশীলন সবার জন্য বাধ্যতামূলক করা হবে। প্রতিটি বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে শিক্ষার্থীদের এই অনুশীলনের আওতায় আনা হবে। তাহলে আমাদের মেয়েরা আর সামাজিক নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে না। ছেলেরাও মার্শাল আর্ট চর্চা করলে শারীরিকভাবে সুস্থ থাকবে। তাদের মন প্রফুল্ল থাকবে। তারা সুন্দর চিন্তা করতে শিখবে। সমাজটা সুন্দর হবে।