জটিল রোগে আক্রান্ত প্রকৌশলী ভাই, চিকিৎসক বোন

রিদওয়ান নুর রহমান ও রেজওয়ানা আজমেরী দুই ভাইবোন। রিদওয়ান রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগ থেকে পাস করেছেন। আর রেজওয়ানা আজমেরী ঢাকার তুরাগ থানার ইস্টওয়েস্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ইন্টার্নি করছেন। তবে তাঁরা এ পর্যন্ত এসেছেন কঠোর সংগ্রাম করে। ছোটবেলা থেকেই তাঁরা জেনারেলাইজড মরফিয়া রোগে আক্রান্ত। পরিবারের বড় মেয়ে রেজওয়ানা মেডিকেল কলেজে প্রায় ১৪ বছর পড়েছেন। শারীরিক অসুস্থতার জন্যই মূলত এত বেশি সময় লেগেছে তাঁর।

বর্তমানে রিদওয়ান ও রেজওয়ানার দুই হাত, দুই পা, কোমর শক্ত হয়ে বেঁকে গেছে। দিন যত যাচ্ছে, ততই শারীরিক জটিলতা বাড়ছে। ফিজিওথেরাপি ও ওষুধেই কাটে তাঁদের দিন। তবে পড়াশোনায় কোনো ছাড় দেননি তাঁরা। দুজনেই এখন স্থায়ী চাকরির অপেক্ষায় আছেন। তাঁদের আরেক ভাই পড়াশোনা করছেন।

রিদওয়ান জানালেন, তাঁদের বাবা রাজিউর রহমান ২০০৭ সালে মারা যান। মা হাসনীন আখতার খানম রংপুরে জনতা ব্যাংকের কর্মকর্তা। ঋণের টাকা ও মায়ের একার আয়েই চলছে তিন ভাইবোনের পড়াশোনা, দুজনের চিকিৎসা। রেজওয়ানা বর্তমানে ইন্টার্নি করছেন বলে মাস শেষে হাতে কিছু টাকা আসছে, যা পরিবারটির জন্য কিছুটা সহায়ক হয়েছে।

রেজওয়ানা আজমেরী। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন
রেজওয়ানা আজমেরী। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন

ইস্ট ওয়েস্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে কথা হয় রেজওয়ানা আজমেরীর সঙ্গে। অ্যাপ্রোন গায়ে থাকলে সহজে বোঝা যায় না তাঁর শারীরিক জটিলতা। হাঁটেন কিছুটা বাঁকা হয়ে। মুখ ও দু-একটি অঙ্গ ছাড়া শরীরের বাকি অংশ কাঠের মতো শক্ত হয়ে গেছে। আজমেরী জানালেন, শরীর শক্ত হওয়ার পরিমাণ আস্তে আস্তে বাড়ছে। দুই বছর ধরে শারীরিক জটিলতা বেড়েছে। একটুতেই হাঁপিয়ে ওঠেন। নিজের কাজগুলোও একা করতে দুর্বল লাগে। হাসপাতালের কাছেই মেডিকেলের হোস্টেলে থাকেন রেজওয়ানা।

রেজওয়ানা জানালেন, তিনি ২০০৪ সাল থেকে ইস্ট ওয়েস্ট মেডিকেল কলেজে পড়ছেন। গত ছয় মাস ধরে ইন্টার্নি করছেন। এ প্রতিষ্ঠানটির প্রতি কৃতজ্ঞতা জানালেন রেজওয়ানা। পড়ালেখা এবং বর্তমানে ফিজিওথেরাপি স্বল্প খরচে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে প্রতিষ্ঠানের সহায়তায়।

জন্মের পর মাত্র আড়াই বছর বয়সে রেজওয়ানার শরীরে জটিলতা দেখা দেয়। ৭ থেকে ৮ বছর বয়সে রোগটি শনাক্ত হয়। দিল্লিসহ বিভিন্ন জায়গায় চিকিৎসা করানো হয়। একপর্যায়ে দীর্ঘ সময় চিকিৎসা বন্ধ থাকে। রিদওয়ান রেজওয়ানার সাড়ে ৬ বছরের ছোট। তাঁর যখন রোগটি ধরা পড়ে তখন পরিবারের সদস্যরা হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। রেজওয়ানা যদি চিকিৎসায় ভালো হন, তাহলেই ছেলের চিকিৎসা করানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তাই সে অর্থে রিদওয়ানের সেভাবে চিকিৎসা হয়নি। মেডিকেল কলেজে পড়াশোনা, নিজে চিকিৎসক হওয়া এবং ঢাকায় থাকার সুবাদে রেজওয়ানা ফিজিওথেরাপিসহ নানান সুবিধা পাচ্ছেন। স্বল্প খরচে নিজের ক্যাম্পাসেই ফিজিওথেরাপি দিতে পারেন। রিদওয়ানের সে সুযোগ নেই। আর খরচ তো আছেই।

চলতে ফিরতে মানুষের নানান কথা তো আছেই। রেজওয়ানা জানালেন, ‘রোগীরা পেছন থেকে বলে, ডাক্তার নিজেই তো খোঁড়ায় খোঁড়ায় হাঁটে।’ হাঁটা পথেও রেজওয়ানাকে রিকশা দিয়ে যাতায়াত করতে হয়। শারীরিক জটিলতার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসকের কাছে যাওয়াসহ অন্যান্য খরচ তো আছেই। রিদওয়ানের বয়স কম বলে শারীরিক জটিলতা তুলনামূলক একটু কম হচ্ছে।

রিদওয়ান নুর রহমান ও রেজওয়ানা আজমেরী। ছবি: সংগৃহীত
রিদওয়ান নুর রহমান ও রেজওয়ানা আজমেরী। ছবি: সংগৃহীত

ইস্ট ওয়েস্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জ্যেষ্ঠ ফিজিওথেরাপিস্ট চিকিৎসক টি এম মনজুরুল ইসলাম ৭ বছর ধরে রেজওয়ানাকে ফিজিওথেরাপি দিচ্ছেন। তিনি জানালেন, রেজওয়ানার শরীর দিন দিন খারাপ হচ্ছে। চিকিৎসা খরচও দিন দিন বাড়ছে।

রেজওয়ানা আক্ষেপ করে বলেন, এবার ঈদে তাঁর বাড়ি যাওয়া হচ্ছে না। দীর্ঘপথ বাস বা ট্রেনে যাতায়াত করতে পারেন না। তাই উড়োজাহাজই একমাত্র ভরসা। অন্য সময় টিকিটের দাম একটু কম থাকলেও ঈদে দাম বেড়ে যায়। ফলে আসা-যাওয়ার খরচ দ্বিগুণ হয়ে যায়। তাই রেজওয়ানা একাই তাঁর ক্যাম্পাসে ঈদ করছেন। এই একই কারণে বাড়িতে থাকা মা ও ভাইদেরও মন খারাপ থাকে ঈদের দিন।

টেলিফোনে রিদওয়ান জানালেন, দুই ভাইবোনের মাসে শুধু ওষুধই লাগে প্রায় ১০ হাজার টাকার। রিদওয়ান একটি ভালো ও স্থায়ী চাকরি চান ।

রোগীর পরিচর্যায় রেজওয়ানা আজমেরী। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন
রোগীর পরিচর্যায় রেজওয়ানা আজমেরী। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন

আর রেজওয়ানার আহ্বান, তাঁদের দুই ভাইবোনের চিকিৎসার দায়িত্বটা যদি সরকার নিত, তবে তাঁদের মায়ের ওপর এখন যে চাপ তা কিছুটা কমত। রেজওয়ানা চান তাঁদের মতো শারীরিক প্রতিবন্ধকতার শিকার ব্যক্তিদের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে একটি আশ্রয়কেন্দ্র ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হোক।