ক্রিকেটকে আমরা ব্যবহার করব আনন্দ ছড়িয়ে দিতে

ডেভ রিচার্ডসন
ডেভ রিচার্ডসন
>ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিলের (আইসিসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক ক্রিকেটার ডেভ রিচার্ডসন। ২০১৮ সালের ৬ আগস্ট এমসিসি স্পিরিট অব ক্রিকেট কাউড্রি লেকচারে বক্তা ছিলেন তিনি। ক্রিকেট কেন স্রেফ একটি খেলার চেয়েও বেশি কিছু, সে কথাই বলেছেন তিনি।

শুভ সন্ধ্যা। এখানে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য ধন্যবাদ। ১৯৯৩ সালে লর্ডসে এসেছিলাম দক্ষিণ আফ্রিকা দলের সদস্য হয়ে। সেবার আমরা প্রথম টেস্ট খেলার আগে রানির সঙ্গে দেখা করেছিলাম। তবে সেবারই আমার প্রথম লর্ডস ভ্রমণ ছিল না। ১৯৭৯ সালে, আমার বয়স যখন ১৯ বছর, তখন এসেছিলাম এখানে। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে বহুজাতিক এক দলকে ডাকা হয়েছিল ইংল্যান্ডে।

সেবার ট্যুর শুরু হয়েছিল লন্ডন থেকে। আমরা ছিলাম ডানুবিয়াস হোটেলে। আমরা যেদিন এলাম সেদিনই লর্ডস শপে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ব্যাট, প্যাড, গ্লাভস কিনে দেওয়ার জন্য। কলিন মিলবার্ন নামের এক ভদ্রলোক ছিলেন আমাদের দলের কোচ। বর্ণিল এক চরিত্র। ভীষণ আগ্রাসী এবং রোমাঞ্চকর ব্যাটসম্যান ছিলেন তিনি। গাড়ি দুর্ঘটনায় একটি চোখ হারানোর পর তাঁর ক্যারিয়ার ছোট হয়ে গিয়েছিল। তিনি কেবল খেলার কৌশলই শেখাতেন না, মাঠের বাইরেও যে অনেক কৌশল আছে, সেগুলোও ধরিয়ে দিতেন। শেখাতেন বিপক্ষ দলের সঙ্গে মিলেমিশে চলার গুরুত্ব। আমরা যেখানেই যেতাম সেখানেই কলিন মিলবার্নের জনপ্রিয়তা দেখে উদ্বুদ্ধ হতাম।

আমাদের ওই দলটির ম্যানেজার ছিলেন কলিন কাউড্রে। তিনি আসলে মেন্টরের চেয়েও বেশি কিছু ছিলেন। তাঁর নামটি বললে চোখের সামনে ভাসে একজন মৃদুভাষী, চমৎকার এবং সব সময় জ্যাকেট-টাই পরা এক ইংরেজ ভদ্রলোকের কথা। সে সময়ের একটি ম্যাচে আমাদের বিপক্ষ দলের হয়ে অতিথি খেলোয়াড় হিসেবে মাঠে নেমেছিলেন তিনি। চা-বিরতিতে খেয়াল করলাম, কলিন হেঁশেলে গিয়ে যাঁরা চা পরিবেশন করছিলেন, তাঁদের ধন্যবাদ দিলেন। পরে আরও খেয়াল করলাম, যেখানেই যাই চা পরিবেশনকারীরা কলিনকে দেখলেই দারুণ খুশিতে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে! খেলা, সতীর্থ, বিপক্ষ দলের সদস্য এবং আম্পায়ারকে কীভাবে সম্মান করতে হয়, এসব ব্যাপারে তিনি আমাদের জন্য ছিলেন জ্বলন্ত উদাহরণ।

ভক্ত হিসেবে আমাদের চাওয়া থাকে খেলোয়াড়েরা খেলাটা উপভোগ করবেন এবং প্রকাশও করবেন। আমরা তাদের আবেগের বহিঃপ্রকাশ, নিষ্ঠা এবং গৌরবোজ্জ্বল মুখ দেখতে পছন্দ করি। আমরা রোবট খেলোয়াড় দেখতে চাই না। একই সঙ্গে চাই না বাজে আচরণও। কিন্তু ইদানীং মাঠ ও মাঠের বাইরে খুব বেশি বেশি বাজে আচরণ চোখে পড়ছে আমাদের। এটা থামাতে হবে। খেলার মাঠে স্লেজিংয়ের নামে ব্যক্তিগত আক্রমণ, অহেতুক শারীরিক সংঘর্ষ, আম্পায়ারের সঙ্গে অসদাচরণ কিংবা বল টেম্পারিং—এগুলো ক্রিকেটের অংশ হতে পারে না।

আমি যাঁদের সঙ্গে বা বিপক্ষে খেলেছি, তাঁদের মধ্যে ছিলেন জন্টি রোডস, শন পোলক, অ্যালান ডোনাল্ড, কোর্টনি ওয়ালশ, রিচি রিচার্ডসন, ডেভিন বুন, রাহুল দ্রাবিড়—অনেক অনেক উদাহরণ আছে। এই খেলোয়াড়েরা জীবন দিয়ে খেলতেন, হাল ছাড়তেন না, নিষ্ঠা এবং উপভোগের মেজাজ নিয়ে খেলতেন। কিন্তু কখনো বিপক্ষ দল বা আম্পায়ারকে অসম্মান করেননি। ভক্তরা তাঁদের খেলা দেখার জন্য মুখিয়ে থাকত। আমি মনে করি, স্লেজিং সময় নষ্ট ছাড়া আর কিছুই নয়। এমন সময়ও গেছে যখন শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশের মতো দলগুলোকে মানসিকভাবে নিগৃহীত করা হয়েছে। তবে তেমনটা আর হতে দেওয়া হবে না।

বাজে আচরণ এবং আগ্রাসী মেজাজে খেলার মধ্যে পার্থক্য আছে। খেলা বা ক্রিকেট মানে বাজে আচরণ নয়। বাজে আচরণ অগ্রহণযোগ্য। ক্রিকেটের বর্তমান আইনে বাজে আচরণের জন্য সর্বোচ্চ ছয়টি টেস্ট অথবা ১২টি ওডিআই বা টি-টোয়েন্টিতে নিষেধাজ্ঞার সাজা ঠিক করা হয়েছে। ক্রিকেট বোর্ড, গ্রাউন্ড স্টাফ, খেলোয়াড়, সাপোর্ট স্টাফ, কোচ এবং দল ব্যবস্থাপকদের অবশ্যই ক্রিকেটের মূলমন্ত্রের অভিভাবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে হবে।

ইদানীং অনেক কোচ কিংবা ম্যানেজার খুব দ্রুত খেলোয়াড়দের সঙ্গে গলা মেলান। আম্পায়ারদের দোষ দিয়ে ম্যাচ রেফারির কক্ষে ঝড় তোলেন। নতুন প্রজন্মের কাছে ক্রিকেট তুলে ধরতে এবং অনুপ্রেরণা দিতে আমরা সবার ওপরই নির্ভর করি। যেকোনো খেলারই মূল লক্ষ্য জয়। তবে তা সবকিছুর বিনিময়ে নয়। বিশেষ করে খেলার যে অখণ্ডতা আছে, তা ভুলে গিয়ে তো নয়ই।

ক্রিকেটের মূলমন্ত্র মানে এই নয় যে খেলাটি কীভাবে খেললাম। ক্রিকেটের বৃহৎ উদ্দেশ্য সফল করাটাই এর মূলমন্ত্র। পৃষ্ঠপোষকেরা প্রথমেই যে প্রশ্নটি আমাদের করে তা হলো, ‘কেন ক্রিকেট?’ … ‘ক্রিকেটের উদ্দেশ্য কী?’ মোদ্দাকথা হলো, ক্রিকেট আবালবৃদ্ধবনিতাকে আনন্দ দেয়, পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত করে। মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে, অনুপ্রেরণা এবং শক্তি দিতে ক্রিকেটের জুড়ি নেই।

ক্রিকেট সব সময় ‘ভদ্রলোকের’ খেলা হিসেবে পরিচিত। তবে এ কথাটি আমরা কেবল খেলাটির বৈশিষ্ট্যের সঙ্গেই যুক্ত রাখতে চাই। যাঁরা খেলেন তাঁদের সঙ্গে নয়। আমরা দীর্ঘদিন ক্রিকেটে নারীদের সম্ভাবনা উপেক্ষা করে এসেছি। তবে এ ক্ষেত্রে বড় পরিবর্তন এসেছে। আর এটা চলতে থাকবে। গত গ্রীষ্মে নারীদের বিশ্বকাপ হলো। ফাইনালের আসর এই লর্ডসেই বসেছিল। সেই আসরে আমরা বিশ্বের আরও অনেক নারীকে ক্রিকেটে আগ্রহী করে তোলার বিশাল সম্ভাবনা দেখেছি।

কেবল খেলোয়াড় বা ভক্ত হিসেবেই নয়, নারীদের কাছে এই খেলা প্রশাসন, ধারাভাষ্য, সাংবাদিকতার জন্যও বিশাল সম্ভাবনার জায়গা। তাঁরা এসব জায়গায় কাজ করতে দারুণ আগ্রহী। গত বছর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, নারীদের বিশ্বকাপের প্রতিটি ম্যাচই টিভিতে সম্প্রচার করা হবে। সম্প্রচারকারীদের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত থেকে এ কাজে উদ্দীপনা দিয়ে গেছি আমরা। শেষমেশ দেখা গেল নারীদের বিশ্বকাপ বিশ্বজুড়ে ১৮০ মিলিয়ন ইউনিক ভিউয়ার পেয়েছে। যা কিনা ২০১৩ সালের চেয়ে ২৬৫ শতাংশ বেশি। এখন দরকার কেবল মানোন্নয়ন। তা করতে পারলে নারীদের ক্রীড়াক্ষেত্র হবে স্বনির্ভর। তখন পৃষ্ঠপোষক এবং সম্প্রচারকারীরাও আগ্রহী হবে।

নেলসন ম্যান্ডেলা একদম ঠিক কথাই বলেছিলেন, ‘খেলাধুলার আছে বিশ্বকে বদলে দেওয়ার ক্ষমতা। আছে অনুপ্রেরণা দেওয়ার শক্তি। মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার এমন ক্ষমতা এতে আছে, যা অন্য কিছুতে নেই। এটি তরুণদের সঙ্গে এমন ভাষায় কথা বলে, যা তারা বোঝে। যেখানে একসময় কেবল হতাশাই ছিল, খেলাধুলা সেখানেও আশার সঞ্চার করে।’

ক্রিকেটের মূলমন্ত্রের জন্য কাজ করা মানে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এই কথাগুলো মনে রাখা। এটা নিশ্চিত করতে হবে যে ক্রিকেটকে আমরা ব্যবহার করব আনন্দ ছড়িয়ে দিতে। ক্রিকেটকে কাজে লাগাব গোটা বিশ্বের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে, অনুপ্রেরণা ও শক্তি দিতে।

ক্রিকেট ও ক্রিকেটের মূলমন্ত্রের সংজ্ঞা এর সঙ্গে যুক্ত মানুষেরাই। মাঠে ক্রিকেটের জন্য দরকার জীবনের চেয়ে বড় কিছু চরিত্রের। কলিন মিলবার্নস, ফ্লিনটফ, শেন ওয়ার্ন, বিরাট কোহলি ও বেন স্টোকসের মতো আগ্রাসী মেজাজের ক্রিকেটারদের দরকার আছে। তবে সঙ্গে সমানভাবে দরকার ফ্র্যাঙ্ক ওরেল, র​্যাচেল হেহো-ফ্লিন্ট, এম এস ধোনি, রাহুল দ্রাবিড় ও কলিন কাউড্রের মতো ক্রিকেটারদের। যাতে নিশ্চিত হয় যে আমরা সবাই ভালো মানুষের পক্ষে। এখানেই ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। (সংক্ষেপিত)

অনুবাদ: মাহফুজ রহমান

সূত্র: আইসিসি-ক্রিকেট ডটকম