কোথায় গেলে মা?

মা কেমন আছ? বাবা তুমি কেমন? জানো মা, সেই ২০০৯ সালের ২ জুলাইয়ের পর এই প্রশ্নের উত্তরটা আর পাইনি! আর বাবার উত্তরটা কখনোই পাওয়া হয়নি। প্রতিবার জুলাই মাস এলেই তুমি কেমন যেন হয়ে যেতে কিন্তু আমরা বুঝতাম না। কারণ, বাবার আদরটাও তো জীবনে তুমিই দিয়েছিলে। কেনই–বা এমন হবে না, সেই মাসেই যে তুমি হারিয়েছিলে তোমার প্রিয় মানুষটিকে, আর আমরা হারিয়েছিলাম আমাদের শ্রদ্ধেয় বাবাকে। বাবাকে দেখেছি বটে কিন্তু কিছুই মনে করতে পারি না তার সম্পর্কে কিন্তু তুমিসহ অন্য সবাই বলত, আমার বাবা নাকি পৃথিবীর সেরা বাবাদের একজন ছিলেন। আর আমার ছোট চাচ্চু বরাবরই বলেন, তিনি ছিলেন একজন শ্রেষ্ঠ মানুষ। আর বড় মামা বলেন, তোমাদের দুর্ভাগ্য যে এমন একজন বাবাকে হারালে। বাবা সম্পর্কে এর চেয়ে বেশি কিছু জানার সুযোগ হয়নি। কারণ, তাকে তো হারিয়েছি সেই দুই বছর বয়সে। মা, আমি যখন তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র, তখন তোমার একটা বড় অপারেশন হয়েছিল। অনেকেই বলত, তুমি নাকি আর বাঁচবে না। আমি এসব কিছুই তখন বুঝতাম না। তবে মনে পড়ে, তুমি যখন ব্যথার অসহ্য যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে শুয়ে পড়তে, আমি তখন বোকার মতো দাঁড়িয়ে দেখতাম আর কাঁদতাম। হঠাৎ কোনো একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি তুমি বাড়ি নেই, তোমাকে নাকি ময়মনসিংহ শহরের কোন এক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে! শুধু দেখতাম, বড় কাকা, নাহয় আরব আলী কাকা সকালে খাবার নিয়ে যেত। এভাবে পাঁচ–ছয় মাস হয়ে যায় তোমার কোনো খোঁজ আমরা পাই না। আমরা দুই ভাই হয়ে গিয়েছিলাম পথশিশুর মতো। পথে পথে ঘুরে বেড়াতাম আর প্রতিবেশীদের বিভিন্ন মৌসুমি ফলের গাছে হানা দিতাম। মা, তুমি বলতে যে আমি নাকি তোমাকে ছাড়া খাটের ওপর থেকেও নামতাম না। আর ছোট থেকেই নাকি আমি প্রচুর মাছ ধরতে পারতাম। তুমি ছিলে না, আমি ওই ছোট্ট বয়সে মাছ ধরতে পুকুরে নেমে যেতাম। এর মধ্যে হঠাৎ একদিন কাকা বলছেন, তোদের মায়ের অপারেশন, দোয়া কোরো মায়ের জন্য। আরও বলল, ঝুঁকিপূর্ণ অপারেশন, না–ও বাঁচতে পারে। সেদিন অনেক করে কেঁদেছিলাম আমরা। হয়তোবা আমাদের মঙ্গলের জন্যই আল্লাহ তোমাকে বাঁচিয়ে ছিলেন। রাতে শুনতে পেলাম অপারেশন সফল।

তুমিও আস্তে আস্তে সুস্থ হতে থাকলে। আর তোমাকে চিকিৎসক অনেক বিধিনিষেধ মেনে চলতে বলেছেন। কিন্তু এই অভাবের সংসারে যখন আবার নতুন করে পা রাখলে, শুরু হলো তোমার জীবনের আরেক কালো অধ্যায়। আমি নিজ চোখে দেখেছি তোমার নিজেকে তিলে তিলে শেষ করে দেওয়ার দৃশ্য। সকালে ঘুম থেকে উঠে রান্না করেছ ঠিকই, আমরাও সবাই খেয়ে যে যার মতো চলে গেছি স্কুলে, মাদ্রাসায়। কিন্তু কোনো দিন জিজ্ঞেস করিনি, মা তুমি কি খেয়েছ? দুপুরে এসে দেখতাম সংসারের কাজে অথবা কখনো পড়ার টেবিলে বসা আফিয়া আর আমার নোট করার কাজে ব্যস্ত। এই শতকষ্টের মধ্যেও তুমি ছিলে সদা হাসি, খুশি ও প্রাণচঞ্চল একজন মহীয়সী নারী। আমার চৌদ্দ বছর বয়সে কখনো দেখিনি তোমাকে আমাদের কোনো চাহিদা অপূর্ণ রাখতে। নিজে ছেঁড়া শাড়ি আর ছেঁড়া ব্লাউজ পরে থেকেও আমার জুতার বায়নায় তুমি বিন্দুমাত্রও পিছপা হওনি। নিজে না খেয়ে আমার জন্য মুরগির কলিজাসহ ভালো অংশটুকু তুলে দিতে একমাত্র তুমিই। সকালে আমি ঢাকা আসব, এ জন্য সারা রাত জেগে থেকে পিঠা বানাতে আর আমার পছন্দের খাবারগুলো রান্না করতে একমাত্র তোমাকেই দেখেছি। জানো, মা, সেদিন সকালে যে আমাকে বিদায় দিয়েছিলে পেছনে কাঁদতে কাঁদতে বড় দাদার পুকুর পর্যন্ত এসেছিলে, সেই সকালটার কথা আজও আমি ভুলতে পারি না। এখনো বাড়ি থেকে বের হলে পেছনে তাকিয়ে তোমাকেই অনুভব করি। কিন্তু আজ হাজারও শূন্যতা নিয়ে আমাকে চলে আসতে হয় বাড়ি থেকে। আমি যখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি, তখন তুমি বলেছিলে, তোরা তিন ভাইবোন বৃত্তি পেলে আমি আকাশে উড়ব। হ্যাঁ, আজ ঠিকই তুমি কথা রেখেছ, তুমি এখন উড়ে বেড়াচ্ছ চাঁদের দেশে। আর আজ তোমাদের রেখে যাওয়া এই তিন সন্তান ছুটে চলছে তোমার দেখানো পথেই। তোমার দোয়ার জন্যই আজ আমরা এত দূর আসছি, নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখেছি। আজ তোমার সন্তানেরা সবাই বড় হয়েছে দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়ছে। জানো, সব ব্যস্ততার মধ্যেও দিন শেষে যখন বালিশে মাথা ঠেকাই, তখনই কেন যেন তোমার মুখটা ভেসে ওঠে আমার চোখের সামনে।

জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে, প্রতিটি নিশ্বাসে তোমাদের স্মরণ করি। বিশেষ করে তোমার সংগ্রামী জীবনের ডায়েরিটা পড়ে চলার পথে সব প্রতিবন্ধকতা দূর করে সামনে এগিয়ে চলার সাহস পাই।

শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।