উদ্যোক্তা হতে চাইলে কী পড়ব?

ছোটবেলায় আমরা সবাই ‘জীবনের লক্ষ্য’ রচনা পড়েছি। বই থেকে মুখস্থ করার সুবাদে প্রায় সবাই-ই খাতায় বড় হয়ে শিক্ষক কিংবা ডাক্তার হওয়ার কথা লিখতাম। কিন্তু মনের গহিনে কি এটাই সত্য?

ডাক্তার, প্রকৌশলী, শিক্ষক, সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা, পাইলট ইত্যাদি জীবনের অনেক লক্ষ্যের ভিড়ে কিছু মানুষ উদ্যোক্তা হতে চান। অন্যের অধীনে চাকরি করার বদলে সমাজের আরও দশজনের জন্য চাকরির ব্যবস্থা করতে চান। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, মাধ্যমিক আর উচ্চমাধ্যমিকের গণ্ডি পাড়ি দিয়ে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার বাস্তবতায় এসব তরুণেরা নিজের স্বপ্ন পূরণে কোথায়, কী বিষয়ে পড়াশোনা করবেন, সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভোগেন। যিনি ডাক্তার হতে চান তিনি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হবেন, প্রকৌশলী হতে চান যিনি, তার জন্য আছে নির্দিষ্ট পড়াশোনার ব্যবস্থা। কিংবা যদি বলি সেনাবাহিনীর সদস্য হওয়ার স্বপ্ন—সে ক্ষেত্রেও আছে নির্দিষ্ট নিয়মনীতি। কিন্তু একজন উদ্যোক্তা হতে চান যে ছেলে বা মেয়েটি, তিনি কী নিয়ে পড়াশোনা করবেন?

পড়া যায় যেকোনো বিষয়

আমাদের জীবনের লক্ষ্য কী হওয়া উচিত, সেটা যতটুকু না আমাদের মনস্তাত্ত্বিক চিন্তা–চেতনা, বিশ্লেষণ দ্বারা প্রকাশিত তার চেয়ে বেশি সমাজ-সংস্কৃতি আর চারপাশ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তাই কেউ উদ্যোক্তা হতে চাইলে বুঝতে হবে, তাঁর মধ্যে উদ্যোগী ও সৃজনশীল মনমানসিকতা সহজাতভাবেই আছে।

প্রথমত, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দেখা যায় সাধারণত উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য নির্দিষ্ট কোনো পড়ালেখার বিষয় নেই, যেমনটা চিকিৎসক বা প্রকৌশলীদের জন্য আছে। আসলে না থাকার পেছনের কারণটা হলো উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য কোনো নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে পড়ার প্রয়োজন নেই। পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন কিংবা জীববিজ্ঞানের যে ছাত্রটা জীবনের আট আনা সময় ল্যাবে কাটিয়ে দিচ্ছেন, তিনি যেমন উদ্যোক্তা হতে পারেন ঠিক তেমনিভাবে ব্যবসা নিয়ে পড়াশোনা করা ছাত্রটাও স্টার্টআপের মালিক হয়ে যান একদিন। ব্যবসা করতে হলে ব্যবসা নিয়েই পড়তে হবে, এমন কোনো কথা নেই।

কিন্তু বিজ্ঞান আর ব্যবসার ছাত্রদের উদ্যোক্তা হওয়ার মধ্যে পার্থক্য হলো, বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা ব্যবহারিক কাজ বেশি করেন, আর এ জন্যই তাঁদের ব্যবহারিক জ্ঞান বাস্তব জীবনে হাতে-কলমের কাজে সফল হতে সাহায্য করে। অন্যদিকে ব্যবসার শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে কাজ করার তেমন একটা সুযোগ সব সময় থাকে না। কিন্তু তাঁদের কোর্স আউটলাইনগুলো এমনভাবে তৈরি করা হয়, যেন তার মধ্যে উদ্যোগী মানসিকতার একটা বীজ বপন করা সম্ভব হয়। আমাদের দেশে ব্যবসা নিয়ে পড়াশোনা করা ছাত্ররা বিপণন জানেন, অর্থনীতি বোঝেন, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ব্যবসার বাজার বোঝেন। আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের প্রায় সব সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবসার ছাত্রদের ‘অন্ট্রাপ্রেনারশিপ’ নামে একটা কোর্স করানো হয়। আজকাল দেখা যাচ্ছে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় শুধু ‘অন্ট্রাপ্রেনারশিপ’ শেখানোর জন্য আলাদা করে বিভাগ চালু করছে।

প্রয়োজন বৈচিত্র্য

উদ্যোক্তা হওয়ার পূর্বশর্ত হলো নিজের মধ্যে সৃজনশীল মানসিকতা লালন করা। আমরা যদি দেখি আমাদের দেশের চারুকলার ছাত্রদের, তাহলে দেখব তাঁদের মতো এত সৃজনশীল খুব কম মানুষই হয়। নতুন কিছু সৃষ্টি করার মতো একটা সুন্দর মানসিকতা তাঁরা প্রায় প্রত্যেকেই নিজের মধ্যে লালন করেন। তাই খেয়াল করলে দেখা যায়, দেশের বিভিন্ন খাতে উদ্যোক্তা শ্রেণির একটি বড় অংশ আমাদের চারুকলার ছাত্রছাত্রীরা।

বিজ্ঞানের ছাত্রদের কথা বলবেন? দেশ এগোয় জ্ঞান-বিজ্ঞান আর গবেষণায়। গবেষণা নেই মানে উদ্ভাবন নেই আর উদ্ভাবন না থাকা মানে বাজারে নতুন কিছু নেই। পৃথিবীতে আপনি সফল কিংবা ব্যর্থ যত স্টার্টআপের দিকেই তাকাবেন, দেখবেন স্টার্টআপ যাঁরা করছেন, তাঁদের দলটির মধ্যে বৈচিত্র্য আছে। মেধা ও দক্ষতার বৈচিত্র্যের মধ্যে একটা ভারসাম্য আছে। অর্থাৎ যিনি বাজার বোঝেন, তাঁর সঙ্গে এমন একজনকে লাগবে যিনি বিজ্ঞান কিংবা গবেষণা করেন। তা না হলে দলে ইতিবাচক ‘সাইনার্জি ইফেক্ট’ (এমন একটি সম্মিলিত শক্তি, যা প্রত্যেকের শক্তির যোগফলের চেয়েও বেশি) আসে না।

অনেক বিষয়ের সমন্বয়

উদ্যোক্তা হতে হলে আপনার যেমন ফিন্যান্স, মার্কেটিং লাগে ঠিক তেমনি কম্পিউটার সায়েন্সের জ্ঞানও লাগে; আবার ব্যবসা যোগাযোগ ভালো বুঝলেও অর্থনীতির জ্ঞানটাও পাশাপাশি সমান থাকা লাগে। অর্থাৎ একজন উদ্যোক্তার মধ্যে যেসব গুণাবলি আপনি দেখবেন তার জন্য কোনো নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করা যথেষ্ট নয়। একটা উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটা পরিষ্কার করি। সাধারণত আমরা ধরেই নিই যে ব্যবসার ছাত্রদের মধ্যেই উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ বেশি। এখন মনে করুন ‘ক’ পড়ছে আন্তর্জাতিক ব্যবসা নিয়ে, ‘খ’ পড়াশোনা করে অর্থনীতি নিয়ে আর ‘গ’ পড়ে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। কে হবে উদ্যোক্তা? যে কেউই হতে পারে। আবার এদের কেউই না-ও হতে পারে। কেননা আন্তর্জাতিক বাজার বোঝে, কিন্তু অর্থনীতির ভাষা বোঝে না; তাহলে হবে না। আবার ল্যাবে দিন–রাত সময় দিচ্ছেন, কিন্তু আগামী দিনের পৃথিবীতে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছেন না কিংবা ব্যবসার ভাষায় বললে গবেষণার মাধ্যমে বাজারে মুনাফা দেখছেন না, তাহলেও হবে না। কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ই আপনাকে ষোলো আনা জ্ঞানের প্যাকেজ দেবে না। আপনাকে শিখতে হবে, প্রতিদিন শিখতে হবে।

ইন্টারনেটের যুগে এখন তো এই শেখার কাজটা আরও বেশি সহজ হয়ে গেছে। পড়ছেন ফটোগ্রাফি নিয়ে, কিন্তু একটুখানি সময় করে অনলাইন কোর্স করার ওয়েবসাইট এডেক্স কিংবা কোর্সেরা থেকে ‘প্ল্যাটফর্ম বিজনেস’–এর ওপর একটা কোর্স করে ফেললেন। নিজের স্টার্টআপটা নিয়ে আগামীর যেকোনো পরিকল্পনায় যে বিষয়েই জ্ঞানের দরকার হোক না কেন, সবকিছুর জন্য এই প্ল্যাটফর্মগুলো এখন উন্মুক্ত।

ব্যবসা, বিজ্ঞান আর চারুকলার ভিড়ে মানবিকের শিক্ষার্থীদের কথা না বললেই নয়। ব্যবসা করবেন কিন্তু সমাজ ব্যবস্থা বুঝবেন না, ইতিহাস-সংস্কৃতি জানবেন না, তাহলে আন্তর্জাতিক বাজারে সফল হওয়া দিবাস্বপ্ন। ‘ইতিহাস কথা বলে’ এ কথাটি এমনি এমনি বলা হয় না। আমরা সব সময় দেখি উচ্চশিক্ষায় ব্যবসার একজন ছাত্রকে সব সময়-ই সমাজ, সভ্যতা, সংস্কৃতি, একটা জাতির উত্থান-পতনের ইতিহাস নিয়ে কিছুটা হলেও জানতে হয়। কেন?

ধরুন, এই ভারতীয় উপমহাদেশের কথা। আমাদের একটা নিজস্ব জীবনদর্শন আছে, যার একটা বিশাল প্রভাব পড়ে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যে। অর্থাৎ আপনি যখনই বড় পরিসরে উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন আপনার মধ্যে লালন করবেন, তখনই আপনাকে পুরো বিশ্ব নিয়ে ভাবতে হবে। তখনই দরকার ইতিহাসের জ্ঞান। আবার ভাবুন নিজেকে একজন ব্যবসায়িক সত্তা হিসেবে, যিনি প্রতিনিয়ত নিজের কাস্টমারদের সঙ্গে দেনদরবার করছেন। তাঁদের মানসিকতা বুঝতে হলেও শুধু গবেষণার বাইরে এসে আপনার মনোবিজ্ঞানের কিছুটা জ্ঞান দরকার।

অর্থাৎ একজন উদ্যোক্তা অনেক গুণাবলির একটি সমন্বিত রূপ। যিনি যত জানেন তিনি তত সফল। কিন্তু সব জ্ঞানের প্যাকেজ আকারের কোনো বিষয় নেই যেখানে পড়লেই উদ্যোক্তা হওয়া যায়। আপনাকে অর্থনীতি, মার্কেটিং, মনোবিজ্ঞান, কম্পিউটার বিজ্ঞান, ফাইন্যান্স, পরিসংখ্যান, ইতিহাস, সবকিছুই জানতে হবে।

তবে এসব সত্যির সঙ্গে আরেকটা কথাও ধ্রুব সত্য যে উচ্চশিক্ষায় শুধু অন্ট্রাপ্রেনারশিপের ওপর জোর দিয়ে অনেক প্রতিষ্ঠান আছে। যদি কেউ উদ্যোক্তা হতে চান তাঁর জন্য ব্যাবসন কলেজ একটি সেরা পছন্দ নিঃসন্দেহে। পাশাপাশি এমআইটি, হার্ভার্ডসহ যারাই যেখানে উদ্যোক্তানির্ভর পৃথিবী বিনির্মাণে কাজ করে যাচ্ছে, সেই প্রতিষ্ঠানই আপনার জ্ঞানার্জনের জন্য ভবিষ্যৎ গন্তব্য হতেই পারে।

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, ইনোভেশন, ক্রিয়েটিভিটি অ্যান্ড অন্ট্রাপ্রেনারশিপ সেন্টার, সহকারী অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়