ভুল স্বীকার করতে শেখো : টিম কুক

বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান অ্যাপলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা টিম কুক। গত ১৬ জুন যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির সমাবর্তনে বক্তা ছিলেন তিনি।
টিম কুক, ছবি: সংগৃহীত
টিম কুক, ছবি: সংগৃহীত

সিলিকন ভ্যালি—তথ্যপ্রযুক্তি জগতের কেন্দ্রস্থল। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে এর যেন এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। বলা যায়, উভয়ই একই বাস্তুতন্ত্রের অংশ। আজ থেকে চৌদ্দ বছর আগে স্টিভ জবস এখানে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তখন সম্পর্ক যেমন ছিল, এখনো আছে এবং আশা করি ভবিষ্যতেও থাকবে। কেমন করে, খানিক পরেই তা বলছি।

কয়েক প্রজন্ম ধরে স্ট্যানফোর্ডের শিক্ষার্থীরা প্রযুক্তিকে নানাভাবে কাজে লাগিয়ে আসছে। উদ্দেশ্য সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা। এদের দলে যেমন আছে তোমাদের মতো স্নাতক, তেমনি আছে মাঝপথে পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়া শিক্ষার্থীরাও।

তোমরা হয়তো জানো, সম্প্রতি তথ্যপ্রযুক্তি খাতে কিছু নৈতিক বিপর্যয় নেমে এসেছে। এতে প্রযুক্তির ওপর থেকে অনেকের আস্থা উঠে গেছে। কিছু অপ্রিয় ঘটনা যেমন আমাদের মূল্যবোধের দিকে আঙুল তুলেছে, তেমনি কিছু বাস্তবতা এসে গুঁড়িয়ে দিয়েছে অনেকের অন্ধবিশ্বাস‌‌।

এত কিছুর পরও প্রযুক্তি তোমাদের টানে। সেটা তোমাদের ভালোর জন্যই।

স্ট্যানফোর্ড তোমাদের বড় স্বপ্ন দেখায়। আবার তোমরা যারা মেধাবী ও অনুরাগী, তারাই সেই স্বপ্ন পূরণে লেগে পড়ো। এই নৈরাশ্যবাদের যুগেও স্ট্যানফোর্ড বেশ আশাবাদী। তারা জানে, মানুষ হিসেবে আমাদের সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা অসীম। তবে এ–ও সত্য, সমস্যা সৃষ্টি করতেও আমরা পারদর্শী। আমি আজ এসব বিষয় নিয়েই কথা বলব। কারণ, এত দিনে আমি জেনেছি, প্রযুক্তি আমাদেরকে বদলায় না। বরং তা আমাদের ভেতরের ভালো বা মন্দকে কয়েক শ গুণ বাড়িয়ে দেয়।

প্রযুক্তি বা রাজনীতি যেকোনো ক্ষেত্রে আজ যত বিপর্যয় ঘটছে, সবই মানবসৃষ্ট।

তোমাদের জন্য আমার প্রথম উপদেশ—ভালো কাজের জন্য সুনাম চাও? তাহলে নিজের ভুলগুলো স্বীকার করতে শেখো।

প্রথম দোলক উদ্ভাবন থেকে শুরু করে আইফোন পর্যন্ত, এ–যাবৎকালের শ্রেষ্ঠ সব আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের গোড়াপত্তন এই সিলিকন ভ্যালিতে। আবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো, শেয়ার করা ভিডিও, স্টোরিজ কিংবা স্ন্যাপস ইত্যাদি ভার্চ্যুয়াল জগতের যে উপাত্তগুলো আজ গোটা বিশ্বকে সংযুক্ত করে রেখেছে, তার প্রায় সবকিছুর সূচনাও এই স্ট্যানফোর্ড প্রাঙ্গণেই!

তবে কিছুদিন হলো প্রযুক্তিশিল্পের সেই সুনাম আর নেই। এখানে কর্মরত অনেকেই আছে, যারা কৃতিত্ব নিতে সিদ্ধহস্ত। কিন্তু নিজেদের গাফিলতির দায়িত্ব নিতে নারাজ।

প্রতিনিয়ত বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কিংবা অনলাইন ডেটাবেইজ থেকে আমাদের ব্যক্তিগত তথ্য চুরি হচ্ছে। গোপনীয়তা লঙ্ঘিত হচ্ছে। সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের হিংসাত্মক মন্তব্যে প্রতিবাদ করছে না কেউ। মিথ্যে খবর উঠে আসছে রাষ্ট্রীয় আলোচনায়। এখন অনেকেই মনে করেন, উদ্দেশ্য ভালো হলে কাজের ফলাফল ক্ষতিকারক হলেও তা ক্ষমার যোগ্য!

অথচ যদি তোমার দোষে কোনো নৈরাজ্যের সৃষ্টি হয়, তাহলে তা সামাল দেওয়ার দায়ভার তো তোমারই! এই সহজ কথাটা কখনো বলতে হবে, ভাবিনি! নিজের ভুলের দায়িত্ব নিতে পারাই হলো বিচক্ষণতা। এর জন্য সাহসের প্রয়োজন।

আজকাল আমাদের জীবন বাজারদরে কেনাবেচা হয়। মুহূর্তে যে কারও ব্যক্তিগত তথ্য হ্যাক হয়ে যায়। গোপনীয়তা ফাঁস হয়। যদি ধরে নিই এটাই স্বাভাবিক—এসব এড়ানোর কোনো পথ নেই, তাহলে আমরা শুধু গুরুত্বপূর্ণ তথ্যই নয়, আরও বড় কিছু হারাতে চলেছি।

তা হচ্ছে মনুষ্যত্ব। আমরা আর মানুষ থাকব না। আমাদের সে স্বাধীনতাটুকুও হারিয়ে যাবে।

ধরো আমরা এমন জগতে বাস করি, যেখানে ডিজিটাল নিরাপত্তা নেই। সেখানে তোমার দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন হতেই পারে। এ তো কোনো অন্যায় নয়! এরপরও তুমি নিজেকে গুটাতে শুরু করবে। ভাবনা ও বক্তব্যে লাগাম আঁটতে চাইবে। কেন জানো? নিরাপত্তার ভয়ে। ধীরে ধীরে তুমি আশা কমিয়ে দেবে, কল্পনায় বেড় দেবে। ঝুঁকি নিতে ভয় পাবে, উদ্যম কমে যাবে। সৃজনশীলতা, ভাবপ্রকাশ এমনকি চিন্তাভাবনাও দমিয়ে রাখতে শুরু করবে। এই হলো ডিজিটাল নজরদারির ভয়াবহ পরিণতি! এর প্রভাব সর্বগ্রাসী!

ভাবতে পারো, তখন জগৎ কতটা ক্ষুদ্র হয়ে যাবে? যেখানে কল্পনার অস্তিত্ব থাকবে না।

নাহ, সে জগৎ আমাদের জন্য নয়! আমরা আরও ভালো কিছু পাওয়ার যোগ্য।

স্বাধীনতা মানে কী? যে সমাজে বড় বড় ভাবনা শিকড় গাড়তে পারে। যেখানে ভাবনাগুলো লালন করার সুযোগ আছে। যেখানে অযৌক্তিক বিধিনিষেধ নেই। আমরা যদি তা বিশ্বাস করি, তাহলে এখনই আমাদের চিন্তাভাবনা ও আচরণ বদলাতে হবে। কারণ, আগের প্রজন্মের মতো তোমাদেরও নিজেদের ভবিষ্যৎ গড়ার সুযোগ থাকা চাই।

প্রিয় স্নাতকেরা, বর্তমানের ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নাও। যদি ভালো কাজের জন্য বাহবা পেতে চাও, তো দায়িত্ব নিতে শেখো।

আমার সর্বশেষ উপদেশ—যেকোনো ঘটনার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। চৌদ্দ বছর আগে এই মঞ্চে দাঁড়িয়ে স্টিভ জবস বলেছিলেন, ‘জীবন ক্ষণকালীন। তাই অন্যের অনুকরণ করতে গিয়ে সময় পার করে দিয়ো না।’

এর সঙ্গে আমি কিছু যোগ করতে চাই, ‘তোমার গুরু তাঁর জীবদ্দশায় হয়তো তোমাকে যেকোনো কিছুর জন্য প্রস্তুত করে যেতে পারবেন। যা তিনি পারবেন না, তা হলো আকস্মিক কোনো ঘটনা সামাল দিতে পারা। তা তোমায় নিজেকে শিখতে হবে।’

এ নিয়ে আমার এক অভিজ্ঞতা আছে। জীবনের শেষ দিকে স্টিভ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। আমার কিন্তু তখনো বিশ্বাস, তিনি সুস্থ হয়ে উঠবেন। আগের মতো কাজে লেগে যাবেন। আজীবন পথ দেখিয়ে যাবেন অ্যাপল কোম্পানিকে। একদিন হয়তো আমি থাকব না। কিন্তু তিনি থাকবেন চিরকাল।

আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো। মারা গেলেন স্টিভ জবস। এর থেকে আমি যা শিখলাম, তা হলো পূর্বপ্রস্তুতি থাকলেও প্রত্যুৎপন্নমতি হওয়া সহজ নয়। এই দুইয়ের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য।

স্টিভের মৃত্যুর পর আমি একা হয়ে পড়লাম। জীবনে কখনো এতটা নিঃসঙ্গ বোধ করিনি। যেমন মাঝেমধ্যে বড় কোনো ধাক্কা পেলে আশপাশে লোকের ভিড়েও কারও কথা কানে যায় না, কারও দিকে খেয়াল থাকে না। সব অনুভূতি ভোঁতা হয়ে যায়। আমার সে অবস্থা হয়েছিল। কিন্তু এর মধ্যেও আমি বুঝতে পারতাম, সবাই এখন আমার মুখ চেয়ে আছে।

অবশেষে শোক কাটিয়ে উঠলাম। বুঝলাম, অন্যের মতো হতে না চেয়ে, আমাকে এখন নিজেই নিজেকে ছাপিয়ে যেতে হবে। নিজেকে বোঝাতাম, অন্যের চাওয়ামতো জীবনের কলকবজা ঘোরাতে আমি চাই না। তোমাদেরও বলব, নিজেকে অন্যের ছাঁচে ফেলতে যেয়ো না। এতে শরীর ও মনে চাপ পড়বে। সেই শ্রম দিয়ে বরং নিজের জীবন নিজেই সাজাও।

আরেকটা জিনিস মনে রাখবে, সবার জীবনেই সুযোগ আসে। হয়তো সে সময় তুমি প্রস্তুত না-ও থাকতে পারো। তোমার কাছে তা চাওয়াও হচ্ছে না। শুধু মনোবল ধরে রাখতে শেখো। অপ্রত্যাশিত ঘটনার ভেতর থেকেও আশা খুঁজে নাও। একে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখো। পথে একা হয়ে পড়লেও নিজের স্বপ্ন অটুট রাখো।

পথ বিচ্যুত হলে চলবে না।

অনেকে অযথা বাহবা পেতে চায়; এমন সব কাজে যার পেছনে তাদের অবদান নিতান্ত কম অথবা নেই বললেই চলে।

এদের চেয়ে ভিন্ন হতে হবে। পৃথিবীতে দাগ কেটে যেতে হবে।

তুমি মৃত্যুর সঙ্গে সবকিছু নিয়ে যেতে পারবে না। তোমাকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য রেখে যেতে হবে।

ইংরেজি থেকে অনুবাদ:

শাহরোজা নাহরিন

সূত্র: স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইট