কে বলে সময় নেই

মিতু কর্মকার। ছবি: সংগৃহীত
মিতু কর্মকার। ছবি: সংগৃহীত

মিতু কর্মকারের জীবনটা কর্মমুখর বটে। উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পরই চারজনের পরিবারের দায়িত্ব নিতে হয়েছে নিজের ছোট্ট কাঁধে। তাই বলে পড়াশোনা থেমে থাকেনি। ঢাকার সরকারি তিতুমীর কলেজে রসায়ন বিভাগে স্নাতক, স্নাতকোত্তর করেছেন। সেই সঙ্গে সমান্তরালে চলেছে চাকরি। অভ্যর্থনাকারীর চাকরি দিয়ে শুরু করে একটি সার্ভিস সেন্টারের জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবেও কাজ করেছেন। দীর্ঘদিন রসায়ন আর সংগীত বিষয়ে শিক্ষকতা করেছেন একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে। এত কিছু পেরিয়ে আবার কেন, কীভাবে তিনি নতুন করে স্নাতকে পড়া শুরু করলেন? গল্পটা একটু পেছন থেকে শুরু করি।

মিতু কর্মকারের মায়ের ইচ্ছা ছিল, তিনি সংগীতকেই জীবনসঙ্গী করে জীবনে ‘কিছু একটা’ করবেন। কিন্তু অল্প বয়সে বিয়ে আর সংসার সেই ‘কিছু একটা’ হতে দেয়নি। তাই চেয়েছিলেন, নিজের স্বপ্নটা মেয়ের ভেতর দিয়ে বাস্তবায়ন করবেন। অতএব, ছোটবেলায় মায়ের ইচ্ছায় পণ্ডিত সঞ্জীব দে আর আচার্য ড. রেজওয়ান আলীর কাছে সংগীতের ওপর তালিম নিয়েছিলেন মিতু। মায়ের কাছ থেকে জন্মগতভাবে পাওয়া গলাটা তো ছিলই। সেই জোরেই প্রায় সব টিভি চ্যানেলে সংগীতের ওপর সরাসরি অনুষ্ঠান করেছেন। করেছেন উপস্থাপনাও।

সব ঠিকই চলছিল। হঠাৎ বেঁকে বসলেন। রসায়নে স্নাতক-স্নাতকোত্তর করার চার বছর পর এবং চাকরিজীবনের প্রায় ১০ বছর পর হঠাৎ একদিন ঠিক করলেন, নতুন করে পড়াশোনা করবেন। আর এবার পড়বেন সংগীত নিয়ে। কারণ, তত দিনে ছোট ভাইকে লেখাপড়া শিখিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ভাই চাকরি শুরু করেছিলেন। কোনো পিছুটান ছিল না। এবার মনোযোগ দিলেন নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়নে। তা ছাড়া স্নাতক-স্নাতকোত্তর করলেও মিতুর কোনো ‘ক্যাম্পাস লাইফ’ ছিল না। কারণ, ওই সময়টা মিতুকে দিতে হয়েছে চাকরিকে।

যেই ভাবা সেই কাজ। আবেদন করলেন ভারত সরকারের আইসিসিআর বৃত্তির জন্য। পেয়েও গেলেন। ভারতের সংগীতের সব চেয়ে পুরোনো বিদ্যাপীঠ গুজরাটের মহারাজা সায়াজিরাও বিশ্ববিদ্যালয়ে (এমএসইউ) হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সংগীতের ওপর স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করার অপূর্ব সুযোগ এল। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা মজার বিষয় হলো, এখানে বয়স কোনো সমস্যা নয়। যেকোনো বয়সের যে কেউ এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য আবেদন করতে পারেন। মিতু কর্মকারের একজন সহপাঠী আছেন, যাঁর বয়স ৫৪! স্নাতকের চতুর্থ সেমিস্টার চলছে মিতুর। এমএসইউতে ইংরেজি, হিন্দি, গুজরাটি, তামিল, তেলেগু—এই পাঁচটি ভাষায় পরীক্ষা দেওয়া যায়। মিতু কর্মকার বেছে নিয়েছেন আন্তর্জাতিক ভাষা ইংরেজিকেই। এখন পর্যন্ত সমস্ত পরীক্ষায় গড়ে তাঁর প্রাপ্ত নম্বর ৮৫ শতাংশ। আর এই নম্বর নিয়ে এখন পর্যন্ত তিনি রয়েছেন প্রথম স্থানে। মিতুর মতে, ‘জীবন তো একটাই। তাই অন্য জীবনের জন্য কোনো স্বপ্ন তুলে রাখার সুযোগ নেই। সবাই বলে, সময় কই? আমার মনে হয়, এইটা সবচেয়ে বড় ভুল কথা। সময় আছে। কেউ যদি কোনো স্বপ্ন দেখে, তাহলে স্বপ্নপূরণের পথে সময় কোনো বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। সে যখন থেকে কাজটা শুরু করবে, তখনই সময়।’

মিতু যত দিনে এমএসইউতে আবেদন করেন, তত দিনে তিনি বাংলাদেশে সংগীতশিল্পী হিসেবে নিজেকে মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছিলেন। বেশ কয়েকটা অ্যালবামও বের হয়েছিল তাঁর। তাই মিতু কর্মকারকে পেয়ে বেশ অবাকই হয়েছিলেন ডিপার্টমেন্টের প্রধান ড. রাজেশ কেলকার। তিনি বলেছিলেন, ‘অন্য সবাই সংগীত শিখে মিডিয়াতে কাজ করতে যায়। আর তুমি মিডিয়ার কাজ ফেলে সংগীত শিখতে এসেছ! এই ঘটনা আমার জীবন এই প্রথম।’

ছুটিতে বাংলাদেশে এসে প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপচারিতায় উঠে এল গুজরাটের ক্যাম্পাসের দিনগুলো। বললেন, ক্যাম্পাসের সবাই তাঁকে কতটা আপন করে নিয়েছে। প্রথম প্রথম তিনি হিন্দিতে নারী আর পুরুষ গুবলেট করে ফেলতেন। আর হাসির হিড়িক পড়ে যেত। অনেকে তো বলত, ‘ঠিক আছে, যাও, তুমিই ছেলে, আমিই মেয়ে।’ আরও বললেন, ক্যাম্পাসের যেকোনো অনুষ্ঠানে কৌশিকী চক্রবর্তীসহ আরও অনেক বিখ্যাত সংগীতশিল্পীর সঙ্গে একই মঞ্চে তানপুরাতে সংগত করেছেন। তা ছাড়া ক্যাম্পাসের হয়ে গুজরাট সরকার আয়োজিত অনুষ্ঠানেও অংশ নিয়েছেন তিনি, দুর্গাপূজার সময় দিল্লিতে বাংলাদেশের হয়ে প্রতিনিধিত্বও করেছেন। গুজরাটের নাকি সব ভালো। সমস্যা একটাই। খাবার। ওখানে নাকি সব খাবারে চানাচুর দেয়। আর প্রচুর মসলা পাওয়া যায় বলেই বোধ হয় খাবার প্রচুর মসলাদার হয়। বাংলাদেশের মতো মাছ, মাংস, সবজি কিছুই নেই সেখানে। কীভাবে থাকবে? বাংলাদেশের মতো মাটি বা নদী তো নেই গুজরাটে। তাই একটা মাটির টান থেকেই যায়। সেই মাটির টানেই ফিরে আসেন বাংলাদেশে, ফিরে আসবেন বাংলাদেশে।

মিতু কর্মকার সংগীতে পিএইচডি করতে চান। তারপর বাংলাদেশে ফিরে হতে চান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। যে মানুষটার স্বপ্নপূরণের সময় আছে, সময়ক্ষেপণ না করে এভাবেই তিনি এগিয়ে যাচ্ছেন সেই স্বপ্নকে সত্যি করতে। আর ইতিমধ্যে প্রমাণও করেছেন, স্বপ্নপূরণের সব সামর্থ্য আছে তাঁর।