বিশ্বায়নের শতকে তোমরা

মডেল: ধ্রুব, গালিব, অরিয়ন, তনিকা, মাঈশা ও ফারিভা। ছবি: সুমন ইউসুফ
মডেল: ধ্রুব, গালিব, অরিয়ন, তনিকা, মাঈশা ও ফারিভা। ছবি: সুমন ইউসুফ
আর কদিন পরই প্রকাশিত হবে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল। শিক্ষার্থীরা এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ বছর যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে, তারা পুরোদমে কর্মজীবনে প্রবেশ করবে আজ থেকে প্রায় চার বছর পর। তখন পৃথিবীটা কেমন হতে পারে? চার বছরে কতটুকু বদলে যাবে চারপাশ? সব বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ এই সময়ে শিক্ষার্থীদের সহায়তা করতে লিখেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) প্রাক্তন ছাত্রী তামান্না ঊর্মি

চলতি শতকটা বিশ্বায়নের। তোমাদের প্রস্তুতিও হতে হবে বিশ্বায়নের উপযোগী। বিশ্বায়ন কথাটার অর্থ আসলে কী? পৃথিবীর অন্য প্রান্তের মানুষের সঙ্গে কথা বলতে পারা? এক দেশে বসে অন্য দেশের টিভি সিরিয়াল ও সিনেমা দেখা? অবশ্যই সেগুলো একটা অংশ, কিন্তু এসবের গভীরে যে মূল ধারণা, তা হচ্ছে ভৌগোলিক অবস্থান, গায়ের রং, জেন্ডার, পোশাক—এগুলো দিয়ে মানুষের পরিচয় বা ব্যক্তিত্ব যাচাই না করা। যদি সে রকমই হয়, তবে পরিচয়টা তৈরি হবে কিসে, ব্যক্তিত্বের অর্থই বা কী হবে? আমার ধারণা, পরিচয় নির্ধারিত হবে তাঁর চিন্তা ও জীবনযাপনের ধরন দিয়ে।

এক দশক আগেও কে ঘরে কী খাচ্ছে, তার মনে কোন ঝড় বইছে, সে কোন কাপড় কিনতে চায়, কার সঙ্গে গল্প করে—এগুলো প্রচারের বিষয় ছিল না সপ্তাহে, রোজ তো নয়ই। কিন্তু এখন প্রতিদিনের রুটিন, গানের তালিকা, বিষণ্নতা, খাবারের থালার বিষয়বস্তু সব নিয়ে খোলামেলা প্ল্যাটফর্মে সবার সঙ্গে গল্প করার সুযোগ মানুষ লুফে নিয়েছে। সুতরাং আসছে শতাব্দীতে তুমি কীভাবে চিন্তা করো এবং তোমার ও আশপাশের মানুষের দৈনিক জীবনে সেই চিন্তার প্রতিফলন কীভাবে ঘটাও—সেটি তোমার পরিচয় হয়ে দাঁড়াবে। অতএব যেই বিষয় নিয়েই পড়ো না কেন, তোমাদের গুরুত্বপূর্ণ একটা লক্ষ্য যদি চিন্তাকে শাণিত করা, ভিন্নমত ও ভিন্ন আচরণের মানুষের সঙ্গে সাম্যতা বজায় রেখে কাজ করা শেখা হয়; সেটা বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত হবে।

বিশ্ববিদ্যালয় নিজেকে তৈরি করার অসাধারণ একটি জায়গা। আমি মনে করি, বিশ্ববিদ্যালয় দুটি জিনিস শেখাতে সবচেয়ে বেশি পারদর্শী। এক. তোমার শেখার ধরন (লার্নিং স্টাইল) এবং দুই. তোমার কোন বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করতে সবচেয়ে ভালো লাগে, সেটা বোঝার সুযোগ দেওয়া। তোমরা ভাবতে পারো যে আমি দ্বিতীয় পয়েন্টটা শুধু দেশের বাইরে যারা পড়বে, তাদের নিয়ে বলছি। ব্যাপারটা একেবারেই তা নয়। সে কথায় একটু পরেই আসছি।

গ্র্যাজুয়েশনের পরে যে কাজেই যোগ দাও না কেন, সেখানে নতুন করে শেখার শুরু হবে। ব্যাপারটি মোটেও এমন নয় যে বিশ্ববিদ্যালয় সব শিখিয়ে পড়িয়ে দিল এবং বের হয়ে তোমরা কাজে লেগে গেলে। সারা জীবন শিখে যেতে হবে নতুন নতুন জিনিস। তোমার ডিগ্রি ভবিষ্যৎ চাকরিদাতা বা বিনিয়োগকারীকে শুধু এ বিষয়ে ধারণা দেবে যে তুমি কোন ধরনের কাজে আগ্রহী এবং কোন বিষয়গুলো নিয়ে প্রাথমিক কিছু ধারণা আছে। এর বাইরের যেটুকু দক্ষতা অর্জন করা যায়, সেটা নিজের তাগিদে এবং নিজ উদ্যোগে নিতে হবে, সেই জায়গাটাতে বিশ্ববিদ্যালয় বেশ কিছু রিসোর্স তোমাদের হাতের নাগালে এনে দিতে পারবে।

সামনের দিনগুলোতে আসছে আরও অনেক নতুন চ্যালেঞ্জ। তোমরা তৈরি তো? ছবি: স্বপ্ন নিয়ে
সামনের দিনগুলোতে আসছে আরও অনেক নতুন চ্যালেঞ্জ। তোমরা তৈরি তো? ছবি: স্বপ্ন নিয়ে

যে বিষয়টি অবশ্যই তোমার শিখে বের হতে হবে, সেটা হলো তোমাকে অনেক অনেক বই, কম্পিউটার, শিক্ষক, গবেষক, অভিজ্ঞ মানুষ, ল্যাবরেটরি দেওয়া হলে কোনটাকে কীভাবে ব্যবহার করে তুমি নতুন একটি দক্ষতা অর্জন করতে পারো। আমি মনে করি, শিগগিরই মূল শেখার বিষয়গুলো অনলাইনভিত্তিক হয়ে যাবে, বিশ্ববিদ্যালয় হবে সম্পর্ক স্থাপন ও সহযোগিতার কারখানা। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মের ভেতর থেকেও নিজের গতিতে, নিজের মতো রিসোর্স ব্যবহার করে বিভিন্ন চিন্তা ও কাজ শিখতে পারতে হবে। পরবর্তী সময়ে যদি তুমি সমাজবিজ্ঞান নিয়ে কাজ করো, তোমাকে দ্রুত অর্থনীতি শিখে নিতে হবে। যদি ইংরেজি সাহিত্যে পেশা গঠন করো, হয়তো দ্রুত ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের কৌশল রপ্ত করে ফেলতে হবে। যদি শিক্ষকতায় যাও, অনলাইন কোর্স নিয়ে কাজের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্য ও চিন্তা বিকাশের মনোবৈজ্ঞানিক ধারণাগুলো প্রয়োগ করা শিখতে হবে, যন্ত্রপ্রকৌশলে কাজ করতে গিয়ে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং শিখতে হবে কাজের ফাঁকে ফাঁকে। এই উদাহরণগুলো ক্ষুদ্র একটি অংশ কেবল। ভবিষ্যতের সব কাজের ধরনগুলো হবে খুবই আন্তবিষয়ক (ইন্টারডিসিপ্লিনারি)।

তবে তার মানে এই নয় যে তোমার কোনো বিষয়ে বিশেষ দক্ষতা থাকা গুরুত্বপূর্ণ নয়। অবশ্যই কাজ করতে ভালো লাগে, এমন একটা বিষয়ে অনেক বছর ধরে অনুশীলন করে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাও অর্জন করতে হবে আন্তবিষয়ক কাজের জন্য নিজেকে উপযোগী করার পাশাপাশি।

তামান্না ঊর্মি। ছবি: সংগৃহীত
তামান্না ঊর্মি। ছবি: সংগৃহীত

এখন আসি ভালো লাগার বিষয়টা নিয়ে। অনেক নতুন এবং পরিশ্রমনির্ভর বিষয়বস্তু শুরুতে ভালো না লাগার সম্ভাবনা অনেক বেশি। প্রথম দিকে লেগে থেকে, ধারণাটা বুঝে নিজের শেখার ধরন অনুযায়ী আত্মস্থ করতে হবে। এরপর উন্মুক্ত চিন্তা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে আগ্রহ তৈরি করে নিজের ভালো লাগার কিছু বিষয় নির্বাচন করা জরুরি। প্রকৌশল, চিকিৎসাবিদ্যা মতো পেশাগত বিষয়েও পছন্দ বেছে নেওয়ার সুযোগ আছে। নিজ বিভাগে বিষয়বস্তু নিয়ে সর্বশেষ অগ্রগতি জেনে রাখতে হবে এবং নিজ বিভাগ থেকে যেসব দক্ষতা অর্জন করা যায়, সেগুলো শেখার জন্য সব সময় তৎপর থাকতে হবে। তা ছাড়া ভিন্ন ভিন্ন বিষয়, ভিন্ন বিভাগের ছাত্রছাত্রী শিক্ষকদের সঙ্গে সময় কাটিয়ে ও কথা বলেও ধারণার পরিসর বাড়ানো যেতে পারে।

ছোটবেলা থেকে যেই পেশাগুলো এবং যেমন কর্মক্ষেত্র নিয়ে শুনে এসেছ, তোমার কল্পনা বা পরিকল্পনা সেটুকুর ভেতরে আটকে রাখার প্রয়োজন নেই। এর মূল কারণ হচ্ছে পুরোনো দিনের পেশা আর কর্মক্ষেত্রের চেহারা পরিবর্তন হয়ে গেছে অনেকটাই এবং আগামী চার-পাঁচ বছরে পরিবর্তনটা আরও লক্ষণীয় হবে নিঃসন্দেহে। এই গতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মকানুন বদল না-ও হতে পারে। তবুও বদলে যেতে হবে নিজের চেষ্টায়। তবে, যেকোনো বিষয়ের সঙ্গে সাধারণ প্রোগ্রামিংয়ের ধারণা, খুব ভালো ইংরেজি ও মাতৃভাষায় বলতে ও লিখতে পারা এবং ভাবনা সাজানোর (ডিজাইন থিংকিং) সাধারণ চর্চাগুলো শিখে নিলে তা নিজেকে আগামীর জন্য তৈরি হতে সাহায্য করবে।

শেষ কথায় বলতে চাই, সফলতার খুব কম অংশই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্যতার ওপর নির্ভর করে। আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে যে রকম দক্ষতা বা বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ দেখেছি, তেমন মানুষই আমি বাংলাদেশের কর্মক্ষেত্রেও দেখেছি। শেখার ধরন আয়ত্ত করতে পারলে এবং সেই সঙ্গে উপভোগ্য একটি বিষয়ে গভীর দক্ষতা অর্জন করলে সাফল্য থেকে তোমাকে আটকে রাখা কঠিন হবে আগামীর দিনগুলোতে।