নারী কৃষকের পণ্য বিক্রি, সমাজ দেখে মন্দ চোখে

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

বিলকিস বেগম (৩৮) নিজের দেড় বিঘা জমিতে ব্রি-২৮ ধানের আবাদ করেছেন। বিঘাপ্রতি ২৫ মণ করে ধান পেয়েছেন। ধানমাড়াইয়ের জন্য শ্রমিকের সঙ্গে তিনি নিজেও হাত লাগিয়েছেন। গত ২৮ মে মুঠোফোনে প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলার পাশাপাশি কাজও করছিলেন সমানতালে।

বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার নাট মরিচাই গ্রামের বিলকিস বললেন, জমিতে আলু ও ধান আবাদের সব কাজ নিজেই তদারকি করেন। স্বামী আবদুল মান্নানের গরুর খামার আছে।

 কিছুটা খুশির আভার আঁচ পাওয়া গেল মুঠোফোনে। বিলকিস বললেন, বীজ ভালো হওয়ায় বিঘায় ১১৬ মণ আলু পেয়েছিলেন। এর মধ্যে প্রতি মণ ৩২০ টাকা করে ৭১ মণ বিক্রি করেছেন। নিজেদের খাওয়ার জন্য রেখে বাকি ৩৩ বস্তা হিমাগারে রেখে দিয়েছেন।

একই গ্রামের কৃষক খোরশেদা বেগম (৩০) বাড়ির উঠানে এক শতক জায়গায় গড়ে তুলেছেন গরু ও হাঁস-মুরগির খামার। স্বামী মামুনুর রশিদ স্থানীয় ডেল্টা লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানিতে ব্যবস্থাপক হিসেবে কর্মরত।

খোরশেদা বললেন, ‘নিজে উপার্জন করতে কার না ভালো লাগে। ছোট পরিসরে খামার করছি। স্থানীয় একটি ডেইরি ফার্মে প্রতিদিন ৩৬ টাকা লিটার করে ৫-৬ লিটার দুধ বিক্রি করি। মুরগির ডিম ও হাঁসের ডিম বিক্রি করি।’

গ্রামটির আরেক কৃষক সেলিনা খাতুন (২৩) সংসারে সচ্ছলতা আনতে পড়াশোনার পাশাপাশি যোগ দিয়েছেন কৃষিকাজে। স্বামী মো. রানা স্থানীয় বাজারে বড় মুদির দোকানের কর্মী। এই দম্পতির ভিটে ছাড়া কোনো জমি নেই। দুই বিঘা জমি বর্গা নিয়েছেন সেলিনা।

 শিবগঞ্জ এম এইচ ডিগ্রি কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সেলিনা জানালেন, এবার বিঘায় ২৫-২৭ মণ ধান পেয়েছেন। জমির মালিককে দেওয়ার পর অর্ধেক পাবেন। এর আগে আলু পেয়েছিলেন প্রতি বিঘায় ১১৫ মণ। সবটাই বিক্রি করেছেন।

সেলিনা দৃঢ় গলায় বললেন, ‘পণ্য বিক্রি করে টাকা যা পাই, আমার কাছে থাকে। বাজারে পণ্য বিক্রির জন্য যেতে পারি না। বাড়িতে লোক এসে ধান, আলু নিয়ে যায়।’

 নারী কৃষকেরা জানালেন, বড় পরিসরের কৃষিকাজে বাজারজাতকরণে নারীদের বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৫-১৬ অর্থবছরের তথ্য বলছে, কৃষিতে সম্পৃক্ত নারী-পুরুষের সংখ্যা ২ কোটি ৫৩ লাখ ৯৮ হাজার। এর মধ্যে নারীর সংখ্যা ১ কোটি ১২ লাখ ১০ হাজার।

শ্রমশক্তিতে অংশ নেওয়া নারীদের গুণগত মান বিষয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা সহযোগী মো. ইকবাল হোসেন পরিচালিত সাম্প্রতিক গবেষণায় বলা হয়েছে, অর্থনৈতিক উন্নয়নে কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ কমে অকৃষি খাতে বেড়েছে। এরপরও নারীর মোট কর্মসংস্থানের ৬০ ভাগ জুড়ে আছে কৃষি।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) জ্যেষ্ঠ রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান বললেন, নারীরা কৃষক হিসেবে স্বীকৃতি পান না। সরকারি সুবিধাদি, কৃষি কার্ড, ভর্তুকি, ঋণপ্রাপ্তি পুরুষ কৃষকদের মতো পাচ্ছেন না। ফলে পুরুষ নেতৃত্বের মধ্য দিয়েই কৃষি কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়া নারীদের কাছে শ্রেয় মনে হয়।

তৌফিকুল ইসলাম খানের মতে, উৎপাদিত কৃষিপণ্য বিপণনে নারীরা বড় প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়েন। বিপণন ব্যবস্থায় নারীকে সম্পৃক্ত করতে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে। নারীরা তাঁদের পণ্য নিয়ে পুরুষের সঙ্গে দর-কষাকষি করছেন, এটা এখনো সমাজ মেনে নিতে পারে না।

নারী কৃষকের পণ্য বিপণনে কেয়ার বাংলাদেশ একটি টোলফ্রি নম্বরের মাধ্যমে বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার নারী কৃষকদের পরামর্শ দিচ্ছে।

কেয়ার বাংলাদেশের কৃষি উৎস প্রকল্পের বিক্রয় প্রতিনিধি হোসনে আরা বললেন, এই নাট মরিচাই গ্রামের এখন ৮০ শতাংশ নারী কৃষিকাজে যুক্ত। তারপরও এ বিক্রয় প্রতিনিধির মুখে কিছুটা হতাশা—বললেন, বাজারজাতকরণে অর্ধেকের কম নারী জড়িত। শ্বশুর-শাশুড়ি, স্বামী মনে করেন, বাড়ির বউ পরপুরুষের (ব্যাপারী) সঙ্গে কথা বলবে?

চিত্র পাল্টাচ্ছে

তৃণমূলের নারী কৃষকদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি হচ্ছে রাজধানীর গুলশানের বিক্রয়কেন্দ্র আউড়িতে। একশনএইড বাংলাদেশের উদ্যোগে গত ১১ এপ্রিল এটি যাত্রা শুরু করে। সংস্থাটির ‘প্রোমোটিং অপরচুনিটিজ ফর উইমেন্স এমপাওয়ারমেন্ট অ্যান্ড রাইটস (পাওয়ার) প্রকল্পের আওতায় গাইবান্ধা, লালমনিরহাটসহ বিভিন্ন জেলার ৬ হাজারের বেশি নারী কৃষক তাঁদের জৈব পদ্ধতিতে উৎপাদিত পণ্য সরাসরি আউড়িতে পাঠাচ্ছেন। নারী কৃষক দল ও ফেডারেশনের যৌথ উদ্যোগে পণ্য বিক্রির জন্য দালালকে কোনো টাকা না দিয়েই পণ্যের ন্যায্যমূল্য কৃষকেরা পাচ্ছেন বলে জানালেন একশনএইড বাংলাদেশের প্রোগ্রাম অফিসার নূরে জান্নাত।

আউড়িতে পণ্য পাঠানো শুরু করেছেন গাইবান্ধার লাকি বেগম। পাওয়ার প্রজেক্টের মাধ্যমে পণ্য বিক্রি করতে লাকি বেগমের নেতৃত্বে যুক্ত রয়েছেন আড়াই হাজার নারী।

লাকি বললেন, গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার কঞ্চিপাড়া ইউনিয়নের পূর্ব চন্দ্রিয়া গ্রামের পাঁচটি ইউনিয়নে কাজ করছেন তাঁরা। তিনি বললেন, নারীদের বাজারে প্রবেশাধিকার নেই। সমাজ ভালো চোখে দেখে না। দালাল ধরে পণ্য বাজারে পাঠালে লাভ বলতে কিছু থাকে না। দেখা যায়, ৩০ টাকার লাউ বিক্রি করে দিতে হয় ১০–১৫ টাকায়। ন্যায্যমূল্যও পাওয়া যায় না। তাই আউড়িতে পণ্য পাঠানো হচ্ছে। সব খরচ শেষে লাভও থাকছে।