তাঁদের সঙ্গী হুইলচেয়ার ও সাহস

স্মৃতির আলাপে হঠাৎই ডুবে গেলেন রত্না আক্তার। সেই আলাপে আমরা জানতে পারলাম তাঁর বাল্যবিবাহের কথা, বিয়ের পরই যৌতুকের নামে নির্যাতিত জীবনের করুণ গল্প, আর সেই নির্যাতনেরই পরিণতি হুইলচেয়ারের কথাও। সেই চেয়ারটা কবজির জোরে ডানে খানিকটা ঘুরিয়ে নিয়ে রত্না বললেন, ‘হাসপাতালে থাকতে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলাম। কোনো স্বপ্ন ছিল না আমার। এই খেলাই আমাকে নতুনভাবে বাঁচার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।’

অনুশীলনের এক ফাঁকে
অনুশীলনের এক ফাঁকে

ঢাকার সাভারের পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্রে (সিআরপি) কথা হচ্ছিল রত্নার সঙ্গে। তিনি এখানে চিকিৎসার জন্য আসেননি, এসেছেন অনুশীলন করতে। রত্নার মতো আরও অনেকেই এসেছেন। তাঁরা এখন বাংলাদেশ নারী হুইলচেয়ার বাস্কেটবল দলের সদস্য। হুইলচেয়ার যাঁদের নিত্যসঙ্গী, সেই সাহসী নারীদের নিয়েই যে এই দল।

পাশেই ছিলেন হুইলচেয়ার বাস্কেটবল দলের মারজানা বিনতে ফরহাদ। ১২ সদস্যের বাস্কেটবল দলটির কনিষ্ঠ এই সদস্যের কাঁধেই দলের নেতৃত্বের ভার। ছোটবেলার ভীষণ ডানপিটে মারজানা পা হারান দুর্ঘটনায়। পা ভেঙে হুইলচেয়ারে বসতে হলেও মনোবল ভাঙেনি তাঁর। হুইলচেয়ারে বসেই এগিয়ে নিয়েছেন পড়াশোনা। মারজানা এখন স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপি বিষয়ে স্নাতক করছেন সিআরপির প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ হেলথ প্রফেশন ইনস্টিটিউটে (বিএইচপিআই)।

সিআরপিতে অনুশীলন ক্যাম্পে এসেছিলেন হুইলচেয়ার বাস্কেটবল দলের সদস্যরা। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন
সিআরপিতে অনুশীলন ক্যাম্পে এসেছিলেন হুইলচেয়ার বাস্কেটবল দলের সদস্যরা। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন

মারজানা বলছিলেন, ‘আমার পাইলট হওয়ার স্বপ্ন ছিল। দুর্ঘটনার কারণে সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। তবে আকাশে ওড়ার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে এই দলের সদস্য হয়ে, হোক সেটা যাত্রী হিসেবে!’

মারজানার সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছিল ২০১৭ সালে নেপাল সফরে। সে বছরই প্রথম বিদেশে যাওয়া। এরপর ২০১৮ সালে ইন্দোনেশিয়া সফর। ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে খেলায় সবচেয়ে মূল্যবান খেলোয়াড়ের (মোস্ট ভ্যালুয়েবল প্লেয়ার) ট্রফি জিতেছেন তিনি। মারজানা বলছিলেন, ‘শারীরিক অক্ষমতাকে জয় করে বাস্কেটবল খেলার মাধ্যমে পরিচিতি পাওয়ায় আমি ভীষণ আনন্দিত। ভবিষ্যতে যাতে আন্তর্জাতিক অন্যান্য টুর্নামেন্টে আমরা অংশগ্রহণ করতে পারি, সে জন্য সরকারের সহযোগিতা চাই।’

অনুশীলনের ফাঁকেই কথা হয় রত্না আর মারজানার সঙ্গে। বাংলাদেশে হুইলচেয়ার বাস্কেটবলের সূচনা সিআরপির উদ্যোগে এবং আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটি (আইসিআরসি) ও জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো–অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) সহায়তায়। প্রথমে পুরুষদের দল গঠন করা হয়। পুরুষের সাফল্যের ধারাবাহিকতায় ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে নারীদের জন্য মাসব্যাপী হুইলচেয়ার বাস্কেটবল প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হয়।

অধিনায়ক মারজানা
অধিনায়ক মারজানা

২০১৭ সালে এই নারী দলের সদস্যরা প্রথমবারের মতো দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট খেলতে যান। নেপালের আয়োজনে তাঁরা রানারআপ হন। ২০১৮ সালে ইন্দোনেশিয়ার বালি স্পোর্টস ফাউন্ডেশন আয়োজিত পঞ্চম বালি কাপ আন্তর্জাতিক হুইলচেয়ার বাস্কেটবল টুর্নামেন্টে অংশ নেন। ইন্দোনেশিয়ার নারী হুইলচেয়ার বাস্কেটবল দলকে ৫ ম্যাচের সিরিজের প্রতিটি ম্যাচে হারিয়ে শিরোপা জেতেন।

সিআরপির ক্রীড়া প্রশিক্ষক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘শুরুর দিকের গল্পটা খুব কষ্টের, কঠিন ছিল দলটা গঠন করতে। তবে সব বাধা অতিক্রম করে আমাদের মেয়েরা বিদেশের মাটিতে গিয়েও জয়ী হয়ে ফিরছে, এটাই অনেক বেশি পাওয়া। এশিয়া-ওশেনিয়া অঞ্চলের টিমের মতো মানসম্পন্ন একটি টিম আমরা গড়ে তুলতে চাই। এ জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাসহ যাবতীয় কাজ করতে চাই।’

এ বছরই দলটি আন্তর্জাতিক হুইলচেয়ার বাস্কেটবল ফেডারেশনের এশিয়া-ওশেনিয়া অঞ্চলের আমন্ত্রণে ২৪ থেকে ৩০ মার্চ থাইল্যান্ডে ডেভেলপমেন্ট ক্যাম্পে অংশ নিয়েছিল। পেয়েছে উচ্চতর প্রশিক্ষণ। গত মাসেই কানাডা ও ভারত থেকে এসেছিলেন দুজন প্রশিক্ষক। তাঁদের তত্ত্বাবধানে ১৯-২৫ জুন পর্যন্ত চলে সেই প্রশিক্ষণ ক্যাম্প।

নিয়মিত এমন প্রশিক্ষণে অংশ নিয়ে প্যারা অলিম্পিকের মতো মর্যাদাপূর্ণ আসরে লড়ার স্বপ্ন দেখছেন এই মেয়েরা। হয়তো সেই স্বপ্নও সত্যি হবে। আর এভাবেই হুইলচেয়ারে বসে বিশ্ব জয়ের বার্তা দেবে মারজানা বিনতে ফরহাদ, ফাহিমা আক্তার, শাকিলা মিতু, সোনিয়া খানমদের বাস্কেটবল দলটি।