হুইলচেয়ারেই প্রেম, সংসার...

হুইলচেয়ারে বসে মনির হোসেন শিকদার বিশেষ কায়দায় কাপড় ধুয়ে ফেলছেন। আর এই ফাঁকে পারভীন আক্তারও হুইলচেয়ারে বসেই স্বামীর পছন্দের গরুর মাংস বা সেমাই রান্না করছেন। মনির কাপড় ধোয়ার পর তা ভাঁজ করার দায়িত্ব পারভীনের। কেননা, মনিরের ভাষায়, পারভীন খুব ভালোভাবে কাপড় ভাঁজ করতে পারেন। এভাবেই এই দম্পতি প্রায় আট বছর ধরে ঘর-সংসার করছেন।

এই দম্পতির সঙ্গে দেখা হলো সাভারের পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্রে (সিআরপি) গিয়ে। মাত্র ৯ বছর বয়সে রাজধানীর মিরপুরে পারভীন ছয়তালা থেকে নিচে পড়ে যান। সিআরপিতে প্রায় ১০ বছর চিকিৎসা শেষে এখানেই চাকরি করছেন। সব মিলে ২০ বছরের বেশি সময় ধরে তিনি সিআরপি ক্যাম্পাসে আছেন। অন্যদিকে, মনির ২০০৯ সালে রাজধানীর আজিমপুরে এক ভবন থেকে আরেক ভবনে লাফ দিয়ে পার হতে গেলে নিচে পড়ে যান। মনির হাসতে হাসতে বললেন, ‘পারভীন ছয়তলা থেকে আর আমি পাঁচতলা থেকে পড়েছি। এই দিক দিয়ে ও আমার চেয়ে সিনিয়র।’

দুর্ঘটনার পর হুইলচেয়ারে করে মনির হোসেন এলেন সিআরপিতে চিকিৎসার জন্য। চিকিৎসা শেষে এখানকার অভ্যর্থনা কক্ষে চাকরি হলো। আর হুইলচেয়ার ঠিকঠাক করতে মনির তখন যে বিভাগে যেতেন, সেখানেই পরিচয় হয় পারভীনের সঙ্গে। মনির বললেন, ‘দেখা হতে হতে দুজনের কাছে আসা, প্রেম হওয়া, তারপর বিয়ে। না জানিয়ে বিয়ে করলেও এখন দুই পরিবারই আমাদের মেনে নিয়েছে। এখন পর্যন্ত আমরা ভালো আছি।’

পারভীন বর্তমানে প্রস্থেটিকস অ্যান্ড অর্থোটিকস (কৃত্রিম হাত-পা বানানো) ল্যাবে কাজ করছেন। পারভীন অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। বাবা মারা গেছেন ছোটবেলায়। পারভীনেরা তিন বোন। মা বেশির ভাগ সময় পারভীনের বাসায় থাকেন মেয়েকে সংসারের কাজে সহায়তা করার জন্য। 

পরিবারকে না জানিয়ে বিয়ে করার কারণ হিসেবে মনির বললেন, ‘বাবা চাইতেন আমি সুস্থ, স্বাভাবিক কোনো মেয়েকে যাতে বিয়ে করি। তাই তখন জানাইনি।’ বিয়ের দেড় বছর পর দুই পরিবারের সদস্যরা বিয়ে মেনে নেন। মনির ঢাকা কলেজ থেকে এমএসসি শেষ করতে পারেননি।

এই দম্পতির সাপ্তাহিক ছুটি শুক্রবার। জানালেন, বাইরে তেমন একটা ঘুরতে যাওয়া হয় না। তাঁদের সুস্থতার জন্যই একটু বেশি পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন থাকতে হয়, তাই সংসারের কাজে সময় বেশি লাগে।

মনির হোসেন শিকদার ও পারভীন আক্তার।  ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন
মনির হোসেন শিকদার ও পারভীন আক্তার। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন

হাসি হাসি মুখে মনির বললেন, মেয়েদের সঙ্গে প্রয়োজনে বা অপ্রয়োজনে কথা বললেই পারভীন খেপে যান। আর পারভীনের সহজ স্বীকারোক্তি, ‘ও ঘরে ফিরতে দেরি করলেই আমার খুব রাগ হয়।’

ঝগড়া করলেও দুজনেই স্বীকার করলেন, তাঁরা একজন আরেকজনকে গুরুত্ব দেন। কেউ কাউকে অবহেলা করেন না। কাজে যে যতটুকু পারেন সহায়তা করেন।

পারভীন জানালেন, টাইফয়েড, বড় একটি অস্ত্রোপচারসহ শরীর ইদানীং খারাপ যাচ্ছে তাঁর। তবে অসুখের সময়ও কখনো মনে হয় না স্বামী তাঁকে অবহেলা করছেন।