ধর্ষকেরা দানব ও অমানুষ তো বটেই

মালেকা বেগম
মালেকা বেগম

অপরাধবিজ্ঞানী মধুমিতা পাণ্ডে বলেছেন, ‘ধর্ষকেরা দানব নয়।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘ধর্ষকদের সঙ্গে আলাপ করার পর আপনি ভীষণ নাড়া খাবেন—এসব লোকের এমন ক্ষমতা আছে যে তাদের কথা শোনার পর তাদের জন্য আপনার খারাপ লাগবে।’ [সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট-এ সাক্ষাৎকার; সূত্র: আনিসুল হক, প্রথম আলো, ১২.৭.১৯ ‘ধর্ষণের পেছনে কী কাজ করে’]

মধুমিতা পাণ্ডে ধর্ষণের শিকার লক্ষ-কোটি লাঞ্ছিত, নির্যাতিত নারীর সঙ্গে আলাপ করে কি বলবেন? নুসরাতের প্রতিবাদী লড়াই কি তাঁকে নাড়া দেবে না? অপরাধবিজ্ঞানীরা অপরাধের শিকার মেয়েদের কথা শুনতে পান না?

হাজার হাজার বছরের চেপে থাকা পিতৃতন্ত্র, পুরুষের আধিপত্য, ধর্ষণের বড় কারণ বলে অপরাধবিজ্ঞানীর বক্তব্য যখন পড়ি বা শুনি, তখন চারপাশে তাকাই, বুঝতে চাই কোথায় এই পিতৃতন্ত্র বাসা বেঁধে আছে—বাড়িতে বাড়িতে? প্রতিষ্ঠানে প্রতিষ্ঠানে? পথেঘাটে? বাসে-ট্রেনে-লঞ্চে? বাজার-দোকানে? সিনেমায়-বইপত্রে? পত্রপত্রিকায়? পরিবারগুলোতে ‘বধূ নির্যাতন’ ধর্ষণের মতোই নারীর বিরুদ্ধে অপরাধ—সেটা যেন না ভুলি।

প্রাগৈতিহাসিক যুগের ইতিহাস অনুসন্ধান করে সমাজবিজ্ঞানীরা নৃবিজ্ঞানীদের গবেষণার ভিত্তিতে তত্ত্ব দিচ্ছেন যে ‘প্রাগৈতিহাসিক জীবন ছিল নারীনির্ভর। মাতৃতান্ত্রিক সমাজ নয়, তখন ছিল মাতৃ-অধিকারভিত্তিক সমাজ।’ প্রাগৈতিহাসিক কাল পেরিয়ে আমরা পৌঁছেছি একুশ শতকের উনিশ সালে। পৃথিবীজুড়ে কীভাবে ধর্ষণের শিকার হয়ে যাচ্ছেন নারী, সেসব তথ্য যখন পত্রিকায়, গবেষণায় পড়ি, তখন ‘ধর্ষকেরা দানব’—সেটা বলতে মোটেও দ্বিধান্বিত হই না।

ধর্ষণের শিকার নারীদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে। হাহাকারে বিদীর্ণ, মর্মাহত, নির্যাতনের শিকার নারীদের জন্য চোখের পানি ফেলেছি নারী আন্দোলনের সংগঠকেরা। আমরা দাবি তুলেছিলাম, ‘বীরাঙ্গনা’ নন, এঁরাও মুক্তিযোদ্ধা। ওঁরা আত্মার রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা এনেছেন।’

কবি সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে মালেকা খান ও অনেকে মিলে নারী পুনর্বাসন সংস্থা গড়ে তুলেছিলেন ১৬ ডিসেম্বর থেকে ২৩ ডিসেম্বরের মধ্যে। পরে সেটি সরকারি ব্যবস্থাপনায় চলেছিল। সে সময় বাংলাদেশে এসেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার শল্য চিকিৎসক ডা. জিওফ্রে ডেভিস। লন্ডনে ফিরে তিনি বলেছিলেন, নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের দুই লাখ নারী পাকিস্তানি বাহিনী দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এঁরা জীবনভর অসুখে ভুগবেন বা বন্ধ্যা হয়ে যেতে পারেন। তিনি সে সময় ১ লাখ ৭০ হাজার নারীর গর্ভপাত করেছেন। নারী পুনর্বাসন সংস্থায় লিপিবদ্ধ ছিল নির্যাতন–ধর্ষণের শিকার নারীদের জবানবন্দি। হামিদা হোসেন ও আমেনা মহসিন সম্পাদিত ২০১৮ সালে ইউপিএল প্রকাশিত ‘একটি জাতির জন্ম যৌন সহিংসতা ও দায়মুক্তি’ বইটিতে এই জবানবন্দির বিষয়ে তথ্যাদি আছে। হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র’ (ঢাকা ১৯৭৮, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ. ২৪৪) বইটিতে এই বিষয়ে তথ্য আছে।

‘বাংকারে বাংকারে’ রাজাকারদের সহায়তায় মুক্তিযুদ্ধের সময় যেসব পাকিস্তানি সেনা নির্বিবাদে ধর্ষণ করেছিল, তাদের ‘দানব’ বলব না, সেটা কি গ্রহণযোগ্য? স্বাধীনতার পর পাকিস্তানি সেনাদের নারী নিগ্রহের বিষয়টি কতটা গুরুত্ব পেয়েছিল? নির্যাতনের শিকার লাখ লাখ নারী বাড়িতে স্থান পাননি—স্বামী-শ্বশুরবাড়ি তো দূরের কথা, মা-বাবাও বাড়িতে নিয়ে যাননি। মা-বাবার স্নেহবঞ্চিত-লাঞ্ছিত, স্বামীর সংসার থেকে বিতাড়িত, ধর্ষণের শিকার নারীদের জীবনে আত্মহত্যার প্রবণতা তৈরি হয়েছিল। সেই পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে আমরা রাজনৈতিক বিচার চাইলেও চাইনি ধর্ষণের শিকার লাখ লাখ নারীর ‘শারীরিক-মানসিক-সামাজিক-পারিবারিক’ লাঞ্ছনার বিচার। বিচারের দাবিতে নারী আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হলেও রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে সেই বিচারের দাবি লিপিবদ্ধ হয়নি সে সময়। এখনো তা বিচারের আলো দেখেনি।

মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন-উৎসর্গের মধ্য দিয়ে, হত্যাযজ্ঞের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা পেয়েছি আমরা। নারীর প্রতি নির্যাতনের ঘটনা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে কতটুকু সোচ্চার? নারী আন্দোলনের ইতিহাসে ছাড়া আর কোথাও তা নারীর মুক্তিযুদ্ধ বলে স্বীকৃতি পায়নি। সেই ধর্ষণের শিকার নারীদের ‘বীরাঙ্গনা’ বলে মুখোশ না পরিয়ে মুক্তিযোদ্ধা বলব না কেন—সেই মীমাংসাও হয়নি আজ পর্যন্ত। মুক্তিযোদ্ধা পদক বা মাসোহারা পাওয়ার বিষয় এটা নয়। এ হচ্ছে ইতিহাসের সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম।

স্বাধীন দেশে ১৯৭২-এর পর চারটি বছর যেতে না যেতে সামরিক জান্তার হত্যাযজ্ঞের শিকার হলেন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে। সেই হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে আমরা আজও সোচ্চার। ১৯৯০ পর্যন্ত সামরিক-বেসামরিক নানা প্রক্রিয়ায় দেশের জনগণের লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হলেও রাজনৈতিক হত্যা- হিংসা-প্রতিহিংসার মধ্য দিয়ে দেশের রাজনৈতিক-সামাজিক-পারিবারিক-সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল দূষিত হয়ে চলেছে।

এই দূষিত সামাজিক পরিস্থিতিতে নারীর প্রতি নির্যাতন উচ্চতম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে শিশু বিদ্যালয় পর্যন্ত ঘটেই চলেছে। জেলায় জেলায়, পাড়ায় পাড়ায়, পথেঘাটে তো বটেই, সুরক্ষিত বহুতল বাড়ির ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে নারী ও শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটে চলেছে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে সবাই আবেদন জানাচ্ছেন, কিছু একটা করুন। প্রধানমন্ত্রী নিজেও বিচলিত হয়ে বলেছেন, ধর্ষকের দ্রুততম বিচার ও কঠোর শাস্তি বাস্তবায়িত করতে হবে।

নারীর শরীর নিয়ে ব্যবসা চলেছে দেশের সর্বত্র। পতিতাকেন্দ্র আইনত নিষিদ্ধ। তবু চলেছে পতিতাকেন্দ্র। চাকরির লোভ দেখিয়ে পতিতাকেন্দ্রের ব্যবসায় বাধ্য করা হচ্ছে বিপদগ্রস্ত মেয়েদের। পুলিশ প্রশাসনের জ্ঞাতসারেই এই ঘটনাগুলো ঘটে চলেছে। নারীদেহভোগী যে ‘পুরুষেরা’ এসব পতিতাকেন্দ্রে যায়, তাদের দেখেছি ‘চোখমুখ ঢেকে’ লজ্জিত হয়ে, সতর্ক হয়ে পতিতাকেন্দ্রে ঢুকতে।

১৯৮৫ সালে শবমেহেরকে নির্যাতনের পর (নারায়ণগঞ্জের টানবাজার পতিতাকেন্দ্রে) ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে নেওয়া হয়। প্রয়াত ডা. ফিরোজা বেগম তাঁর চিকিৎসার দায়িত্বে ছিলেন। চোখের পানিতে দুঃখভারাক্রান্ত গলায় আমাদের বলেছিলেন, ‘ওই সব দানবের ক্ষমা নেই, চরম শাস্তি দেওয়া দরকার।’ বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ থেকে সুফিয়া কামাল, আমি, বেলানবী ও অন্য নেত্রীরা আকুল হয়ে, ক্রুদ্ধ হয়ে বিচারালয়ে মামলা চালিয়েছিলাম। দালাল ও সর্দারনীর সাজা হলেও মূল হোতা ও ‘দানব’ মমতাজ মিয়া ছাড়া পেয়ে যায়।

সম্প্রতি প্রশ্ন তুলেছি এক সাহিত্য সভায়, (যেখানে নারী-পুরুষ কবি-সাহিত্যিক-সমাজকর্মীরা ছিলেন) সাহিত্যিক নারী-পুরুষ উভয়েই ‘পতিতা’কেন্দ্রের মেয়েদের কথা লিখেছেন, লিখছেন মর্মাহত হয়ে; ওরা কীভাবে দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে ‘দানব’ দালাল ও নির্যাতনকারীদের অত্যাচারে। জানতে চেয়েছি, পতিতাকেন্দ্রে ‘পতিত’ পুরুষেরা যায়। নারীদের নির্যাতন ও ধর্ষণ করে, সেই পুরুষদের সাহিত্যিকেরা ‘ধর্ষক’ বলছেন না কেন? অর্থের বিনিময়ে ‘দানব’ এসব পুরুষ যখন নারীদের ‘দেহ’ ব্যবসায় বাধ্য করছে, তখন সুশীল সমাজের সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক সুধীমণ্ডলী কেন প্রতিবাদী হয়ে সেসব ‘দানবের’ মুখোশ খুলে দেন না?

সাড়া দিয়েছিলেন উপস্থিত সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক পুরুষ ও নারী ব্যক্তিত্বরা। হয়তো তাঁরা লিখবেন। কিন্তু লিখলেও তা কি আন্দোলনে রূপ নেবে, নাকি সাহিত্যরসের সামগ্রী হবে—জানি না।

প্রশ্ন তুলেছি নারী আন্দোলনের সহকর্মী ও নেত্রীদের কাছে যে আমরা প্রত্যেকে যে পাড়ায় থাকি, যে এলাকায় কাজ করি, সেই এলাকায় কেন সংগঠিত করি না নারী ও পুরুষকে? প্রত্যেকের দায়িত্বে পাড়ায় পাড়ায় কেন গড়ে তুলি না আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড? ব্যস্ত সবাই। তবু যার যার এলাকায় এক ঘণ্টা সময় দিলেও সুন্দর-সুস্থ একটা পরিবেশ গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে আমার জানামতে ১৯৪০ থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত। পাড়া-মহল্লায় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের গুরুত্ব কমে গেল ‘এনজিও’—অর্থাৎ বিদেশের অর্থে পরিচালিত সংগঠনের আবির্ভাবে। এবং নিশ্চয়ই আমার অজানা আরও বহু কারণে।

পেশাগত নির্ধারিত কাজের দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে সমাজ বদলের তাগিদ ও প্রেরণা হারিয়ে যাচ্ছে। তবু মাঝেমধ্যে খবর পড়ি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান গড়ে পুরুষ ও নারী উদ্যোগ নিচ্ছেন নিজ নিজ এলাকায় সুষ্ঠু সুন্দর প‌রিবেশ গড়ার জন্য। আশাবাদী হয়ে নিজেও যুক্ত হই কোনো কোনো কর্মকাণ্ডে। আবার হতাশা গ্রাস করে। মধুমিতা পাণ্ডে বলেছেন, সমাজকে প্রতিবাদী হতে হবে। মুখ খুলতে হবে। সবার মতো তিনিও পারিবারিক শিক্ষার ওপর জোর দিয়েছেন। আমরাও সেই কথাই বলছি। কিন্তু পরিবারের সেই শিক্ষার দায়িত্বটা কে নেবেন? শিক্ষাকেন্দ্রগুলোতেই যখন ঘটছে ধর্ষণের নির্যাতন?

সম্প্রতি সংগ্রহ করে পড়লাম সিএনএন প্রচারিত একটি তথ্যপত্র। সারা পৃথিবীর মতো বাংলাদেশেও মহামারী আকারে নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেই চলেছে।

আমাদের সংবাদপত্রে, টেলিভিশনে, ফেসবুকে প্রতিদিন প্রচারিত হচ্ছে ভয়াবহ নারী ধর্ষণের খবর। বিচারহীনতা, বিচারের দীর্ঘ সময় লেগে যাওয়া এবং হঠাৎ করে বিচার বন্ধ হয়ে যাওয়া নির্যাতনের শিকার কত নারীর জীবন ধ্বংস করে দিচ্ছে, তার হিসাব রাখা সম্ভব হচ্ছে না। কত ‘তনু’ হত্যার বিচার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, কত ‘তনু’ হত্যার ঘটনা আরও ঘটেই চলেছে, সে কথা কি আমরা জানতে পারছি?

‘দানব’ ধর্ষকদের আমরা কীভাবে দমন করব, সেটা ভাবা জরুরি হয়ে পড়েছে।

চেয়ারপারসন, সোশিওলজি অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগ, সেন্ট্রাল উইমেনস ইউনিভার্সিটি