লক্ষ্য মানেই দ্রুত গতিতে ছোটা নয় : নিল আর্মস্ট্রং

নিল আর্মস্ট্রং (৫ আগস্ট, ১৯৩০–২৫ আগস্ট, ২০১২)
নিল আর্মস্ট্রং (৫ আগস্ট, ১৯৩০–২৫ আগস্ট, ২০১২)
চাঁদের হাজার বছরের নিঃসঙ্গতা প্রথমবারের মতো ঘুচিয়েছিলেন নিল আর্মস্ট্রং। যে চাঁদ ছিল মানুষের রাতের আকাশে, গান, কবিতা আর গল্পে, সে চাঁদকে প্রথমবারের মতো ছুঁয়ে দিয়েছিলেন এই মার্কিন নভোচারী। ‘অ্যাপোলো–১১’ অভিযানের কমান্ডার আর্মস্ট্রং চাঁদের বুকে পা রেখেছিলেন ১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই। গতকাল চন্দ্রজয়ের ৫০ বছর পূর্তি হলো। মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার ৫০ বছর পূর্তি হয় ২০০৮ সালে। সে উপলক্ষে একই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত স্মিথসোনিয়ান এয়ার অ্যান্ড স্পেস মিউজিয়াম এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। সেখানে বক্তব্য দেন নিল আর্মস্ট্রং

ন্যাশনাল অ্যারোনটিকস অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ১৯৫৮ সালের গ্রীষ্মে জাতীয় মহাকাশ আইন প্রতিষ্ঠা করে। কংগ্রেস আইনটি প্রণয়ন করে, সেটিতে সই করেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। ৫০ বছর আগের ওই সপ্তাহটির কথা পরিষ্কার মনে আছে। আমি সে সময় ক্যালিফোর্নিয়ার মরুভূমির অনেক ওপরে উড়োজাহাজ নিয়ে উড়ছি।

১৯৫৮ সালের পয়লা অক্টোবর নাসা পরিণত হলো অপারেটিং এজেন্সিতে। তবে বুধবার সকালে আমি একই চাকরি করতে গেলাম পুরোনো ওই অফিসেই। কাজও করলাম একই, যেমনটা করেছিলাম তার আগের দিনেও। তুলনামূলকভাবে রূপান্তরটি ছিল বেশ সহজ। আমরা একইভাবে রকেট আর রিসার্চ এয়ারক্রাফটে চড়ে বসলাম। আমরা জানি, কী করে উল্টো দিক থেকে গুনতে হয়, ‘৮, ৭, ৬, ৫…’।

আমাদের উড়োজাহাজ, ট্রাক আর ভ্যানগুলোর গায়ে লেখা ছিল NACA। তার মধ্যে ‘C’ অক্ষরটির জায়গায় ‘S’ বসাতে সামান্যই রং চড়াতে হয়েছিল [নাসার (NASA) আগের নাম ছিল NACA (ন্যাশনাল অ্যাডভাইজরি কমিটি ফর অ্যারোনটিকস)]। নতুন এজেন্সি হিসেবে আরও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্রের ওপরেও একই কাজ করতে হয়েছিল—রং চড়াতে হয়েছিল সামান্যই।

আমার ধারণা, আজ এখানে কেউ কেউ আছেন, যাঁরা নাসার শুরুর সঙ্গী এবং সে দিনগুলোর কথা দিব্যি মনে করতে পারবেন। তাই নাসার প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্যদের, যাঁরা বিভিন্ন জায়গা থেকে ১৯৫৮ সালে নাসায় যোগ দিয়েছিলেন, অনুরোধ করছি হাত উঁচিয়ে আওয়াজ তুলুন। অভিনন্দন! আপনারা ‘বুড়ো’ হিসেবে স্বীকৃত। আমরা, এই বুড়োরা আসলে দারুণ গর্বিত।

অর্ধশত বছর পর, আজকের এই রাতে আমরা পেছন ফিরে তাকাতে পারি—কী কাজ করেছি। এই মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান হাজার হাজার গুণ বেড়েছে। আমরা জেনেছি, মানুষ পৃথিবীর মহাকর্ষীয় শক্তিতে আজীবনের জন্য আটকে থাকে না। আকাশযানের কর্মক্ষমতা, দক্ষতা, নির্ভরযোগ্যতা এবং নিরাপত্তার দারুণ উন্নতি হয়েছে। আমরা সৌরজগৎ এবং তারও বাইরে অনেক কিছুই পাঠিয়েছি। মহাবিশ্বকে আরও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পারছি আমরা। এবং মহাবিশ্বের প্রায় শুরুর দিকটাও আমাদের কাছে পরিষ্কার।

যুক্তরাষ্ট্র বনাম সোভিয়েত ইউনিয়নের মহাকাশ প্রতিযোগিতা—আমরা সম্ভবত সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ শান্তিকালীন প্রতিযোগিতার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলাম। যুদ্ধের মতোই ব্যয়বহুল ছিল সে প্রতিযোগিতা। যুদ্ধের মতোই উভয় পক্ষ চেয়েছিল বিপক্ষের প্রয়োগ করা বুদ্ধিমত্তা অর্জন করতে। আমি দাবি করছি না যে ওই মহাকাশ প্রতিযোগিতা যুদ্ধ প্রতিহত করার একটি উপায় ছিল। তারপরও ওই প্রতিযোগিতা আসলে যুদ্ধ প্রতিহতই করেছিল। প্রতিযোগিতাটি ছিল ভীষণ তীব্র, যা কিনা দুই পক্ষকে বিজ্ঞান, শিক্ষা এবং অন্বেষণের মহাসড়কে নামিয়ে দিয়েছিল।

এমনকি ওই প্রতিযোগিতা প্রতিপক্ষের মধ্যে সৃষ্টিশীল সহযোগিতার এক পদ্ধতিও গড়ে তুলেছিল। প্রতিযোগিতাটি দুই পক্ষের জন্য ছিল ব্যতিক্রমী এক জাতীয় বিনিয়োগ। একটি কথা জোর দিয়ে বলি—নাগরিককে, বিশেষ করে তরুণ নাগরিককে ভালোবাসতে, শিখতে এবং সমাজের উন্নয়নে অবদান রাখতে উৎসাহিত করা সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। সে মাপকাঠিতে সরকারি উদ্যোগগুলোর মধ্যে নাসা নিঃসন্দেহে ওপরের দিকেই থাকবে।

‘লক্ষ্য’ বিষয়টি দ্রুতগতিতে ছুটে চলা, উচ্চতর অবস্থানে আরোহণ কিংবা বিশাল দূরত্ব অতিক্রম করার চেয়েও বেশি কিছু। আমাদের লক্ষ্য, যেটি আমাদের দায়িত্বও বটে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি করা। সুযোগ আছে বিশ্বসংসারের বাইরে মানুষের জ্ঞানের পরিধি বিস্তৃত করাতে, অন্বেষণে এবং নতুন জনবসতি স্থাপনে। আমাদের সর্বোচ্চ এবং গুরুত্বপূর্ণ কামনা হলো, মানুষের এই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বুদ্ধিমত্তা, চরিত্র এবং প্রজ্ঞার উন্নতি সাধন হবে। তা হলে পরে আমরা ওই সুযোগগুলোর সঠিক মূল্যায়ন করে বেছে নিতে পারব। আমি চেয়ে আছি নাসার ১০০ বছর পূর্তির দিকে। যেদিন আমরা সবাই আবার একত্র হব। এবং সেখানে দেখব অগ্রযাত্রা ও রোমাঞ্চকর উন্নয়নের চমৎকার প্রতিবেদন।

ইংরেজি থেকে অনুবাদমাহফুজ রহমান, সূত্র: নিউ সায়েন্টিস্ট

নিল আর্মস্ট্রং
নিল আর্মস্ট্রং
টুকরো টুকরো নিল আর্মস্ট্রং