স্যানিটারি প্যাড: বিলাসিতা বনাম প্রয়োজনীয়তা

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

নতুন অর্থবছরের (২০১৯-২০) বাজেটে স্যানিটারি প্যাডের কাঁচামাল আমদানির ওপর অতিরিক্ত ৪০ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করায় এ নিয়ে বেশ বাদ–প্রতিবাদ হয়ে গেল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শুরু হলেও এই প্রতিবাদ পরে ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র; এ নিয়ে চলে আন্দোলন, মানববন্ধন। কাঁচামাল আমদানির ওপর এই অতিরিক্ত ৪০ শতাংশ ভ্যাট ছাড়াও এর সঙ্গে রয়েছে কাস্টমস ডিউটি, অগ্রিম আয়কর, রেগুলেটরি ডিউটি ও আগের মূল্য সংযোজন কর, যা ১৫ শতাংশ। এসব কারণে স্যানিটারি ন্যাপকিনের যে মূল্য দাঁড়ায়, তা একে সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে নিয়ে যায়। কিন্তু প্রশ্ন জাগে, স্যানিটারি প্যাডকে একটি বিলাসী দ্রব্য গণ্য করা কতটা যুক্তিসংগত? 

বাংলাদেশে অবকাঠামোগত অবস্থা এমন যে এখানে একজন নারীর পক্ষে, বিশেষত ঋতু অবস্থায় স্যানিটারি প্যাড একটি অত্যন্ত দরকারি পণ্য। এখানে পাবলিক টয়লেটের সংকট কিংবা রক্ষণাবেক্ষণের অভাব টয়লেটগুলোকে ব্যবহারের অযোগ্য করে তোলে। কাজেই যাঁরা শিক্ষার উদ্দেশে কিংবা কর্মস্থলের কারণে দীর্ঘ সময় বাইরে অবস্থান করেন, তাঁদের পক্ষে স্যানিটারি প্যাডের বিকল্প চিন্তা করা এক রকম অসম্ভব। কিন্তু প্যাডের ওপর উচ্চ হারে ভ্যাট বসানোর কারণে এর মূল্য যা দাঁড়ায়, তাতে একে ক্রয় করার সামর্থ্য রাখেন খুব কম সংখ্যক নারী।

উপরন্তু, যে প্যাডের শোষণক্ষমতা যত ভালো, তার দামও তত বেশি। স্যানিটারি প্যাডের অত্যধিক দামের কারণে অনেক নারী তুলা বা কাপড় ব্যবহার করেন, যার একটি সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়ে যায় নারীর জরায়ুর ওপর। প্রজনন সীমার মধ্যে অবস্থানকারী একজন নারী প্রতি মাসেই মাসিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যান। স্যানিটারি প্যাড সেই প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত একটি পণ্য, যা নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য রক্ষায়ও ভূমিকা রাখতে পারে। এ রকম একটি পণ্যকে ‘নিত্যপ্রয়োজনীয়’ দ্রব্য হিসেবে বিবেচনার পরিবর্তে ‘বিলাসী পণ্য’ হিসেবে গণ্য করা নারীর প্রতি উদাসীনতা এবং অবহেলার সংস্কৃতিকেই স্পষ্ট করে।

মাসিক বা ঋতুচক্রকে একটি মেয়েলি বিষয় হিসেবে গণ্য করে এর ওপর আরোপ করা হয় অযাচিত লজ্জা। একে একটি গোপনীয়তার মোড়কে আবৃত করে রাখা হয়। ফলে মাসিকের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিষয়সমূহ আলোচনার বাইরেই থেকে যায়। আমাদের পাঠ্যপুস্তকে মাসিক নিয়ে আলোচনার সুযোগ থাকলেও লজ্জার সংস্কৃতি একে এড়িয়ে যাওয়াকে উৎসাহিত করে। গণমাধ্যমে সাম্প্রতিক কালে মাসিক নিয়ে কিছু অনুষ্ঠানের আয়োজন চোখে পড়ে। কিন্তু এখনো স্যানিটারি প্যাডের ৯৫ শতাংশের বেশি বিজ্ঞাপনে মাসিককে একটি লজ্জার এবং গোপন বিষয় হিসেবে দেখানো হয়, যা মাসিক নিয়ে যেকোনো সুস্থ আলোচনাকে নিরুৎসাহ করে।
প্যাড একটি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য হলেও একজন নারীর পক্ষে বাজারে গিয়ে এটি ক্রয় করাকে লজ্জার বিষয় হিসেবে গণ্য করা হয়। আর যদিওবা নারী ক্রয় করতে এগিয়ে যান, বিক্রেতা প্যাডের প্যাকেটটিকে নানা মোড়কে আচ্ছাদিত করতে থাকেন, যা নারীটিকেও একটি বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে দেয়। মাসিক নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত গোপনীয়তা বয়ঃসন্ধিকালে কিশোরীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব বিস্তার করে।
আবার এই গোপনীয়তার কারণে মাসিকের সময় ব্যবহার্য কাপড় সঠিক প্রক্রিয়ায় ধৌতকরণ, পরিষ্কার ও রৌদ্রোজ্জ্বল জায়গায় শুকানো—এর কোনোটিই করা হয় না। এতে জরায়ুর প্রদাহ থেকে শুরু করে নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য হুমকির সম্মুখিন হতে পারে।

অথচ সঠিকভাবে স্যানিটারি প্যাডের ব্যবহার নারীর প্রজনন অঙ্গের সুরক্ষার পাশাপাশি নারী শিক্ষার হার বৃদ্ধিতেও ভূমিকা রাখতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, বিনা মূল্যে স্যানিটারি প্যাডের সরবরাহ বিদ্যালয়ে নারী শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির হার বৃদ্ধি করে, আবার দরিদ্র নারীদের কর্মস্পৃহা বাড়ায়। আফ্রিকার গ্রামাঞ্চলের স্কুলগুলোতে মাধ্যমিকের পর থেকে নারী শিক্ষার হার কমতে থাকলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিনা মূল্যে প্যাড বিতরণ করে দেখা যায় যে উদ্যোগটি নারী শিক্ষার্থীদের সংখ্যা আশাব্যঞ্জক হারে বৃদ্ধি করেছে। নেপালেও এ ব্যবস্থা চালু আছে প্রত্যন্ত গ্রামের দরিদ্র স্কুলগুলোতে। বাংলাদেশেও এ উদ্যোগ নিঃসন্দেহে সফলতা বয়ে আনবে। নারী শিক্ষাকে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশে অবৈতনিক শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা থেকে শুরু করে এই শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি প্রদানসহ অনেক উদ্যোগই নেওয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিনা মূল্যে প্যাড বিতরণ করার মাধ্যমে নারী শিক্ষার অগ্রগতিতে কাঙ্ক্ষিত মাইলফলক অর্জন সম্ভব। এ ছাড়া সরকারি স্বাস্থ্য ক্লিনিকগুলোতে দরিদ্র নারীদের জন্য বিনা মূল্যে প্যাড সরবরাহ করা হলে তা নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সে ক্ষেত্রে স্বল্প আয়ের কর্মজীবী নারীরাও এই প্রজনন সেবার অংশীদার হতে পারবেন।

স্যানিটারি প্যাডের ওপর ‘পিংক ট্যাক্স’ বা ‘ট্যাম্পন ট্যাক্স’ আরোপ করার প্রবণতা দেখা যায় বিশ্বব্যাপী। কিন্তু নারীদের দাবির মুখে বিশ্বের অনেক দেশেই প্যাডের ওপর থেকে ভ্যাট এবং অন্যান্য কর উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে। আয়ারল্যান্ড, মালয়েশিয়া, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কিছু অঙ্গরাজ্যে প্যাডের ওপর কোনো ধরনের কর দিতে হয় না। এ বছরের জানুয়ারিতে অস্ট্রেলিয়াও এ তালিকায় নাম লিখিয়েছে। নারীদের আন্দোলনের মুখে যুক্তরাজ্যে স্যানিটারি প্যাডের ওপর করের পরিমাণ ১৭ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে।
পরিশেষে বলতে চাই, বাংলাদেশে স্যানিটারি প্যাড ব্যবহারের ইতিহাস বেশি দিনের নয়। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে একে সব নারীর ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসতে পারলে এটি নিঃসন্দেহে সরকারের এসডিজি গোলের (৩, ৪, ৫, ৬, ১০ ও ১১) লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথকে সুগম করবে।

সেই সঙ্গে দরিদ্র নারী এবং স্কুলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্যাড বিনা মূল্যে বিতরণের উদ্যোগও সরকারকেই নিতে হবে। ব্যবহার্য প্যাডের সুষ্ঠু নিষ্কাশন নিশ্চিত করতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থলে পর্যাপ্তসংখ্যক টয়লেট স্থাপন এবং এর সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
পরিবেশের কথা বিবেচনায় রেখে পরিবেশবান্ধব প্যাড তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ এবং তা ব্যবহারে নারীদের উৎসাহিত করতে হবে। আশার কথা, প্রবন্ধটি লেখার সময় অবগত হলাম যে প্যাডের কাঁচামালের ওপর নতুন করে অতিরিক্ত ৪০ শতাংশ ভ্যাট আরোপের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসা হয়েছে।
আশা করছি, বাকি ১৫ শতাংশ ভ্যাটও উঠিয়ে দিয়ে এবং উপরোল্লিখিত বিষয়গুলো বিবেচনায় এনে নারীর উন্নয়নের পথটি সুগম করার ক্ষেত্রে সরকার অচিরেই পদক্ষেপ নেবে।

উম্মে বুশরা ফাতেহা সুলতানা: শিক্ষক, উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়