এখন সময় এগিয়ে চলার

এই মাথায় হাত কিন্তু দুশ্চিন্তায় নয়! কর্মশালার অংশ হিসেবেই হাসিমুখে মাথায় হাত রেখেছিল সবাই। ছবি: সৈয়দ আমীর হায়দার
এই মাথায় হাত কিন্তু দুশ্চিন্তায় নয়! কর্মশালার অংশ হিসেবেই হাসিমুখে মাথায় হাত রেখেছিল সবাই। ছবি: সৈয়দ আমীর হায়দার
>‘আলোর পথে প্রীতির সাথে’ স্লোগান নিয়ে ২২ জুলাই রাজধানীর শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরে আয়োজন করা হয় ‘তারুণ্যের জয়গান: ঢাকা পর্ব’। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, কিশোর আলো ও প্রথম আলোর রোববারের ক্রোড়পত্র ‘স্বপ্ন নিয়ে’র সম্প্রীতি প্রকল্পের অনুষ্ঠান এটি। যার মূল উদ্দেশ্য, সহিংস উগ্রবাদ থেকে তরুণদের সচেতন করা ও দূরে রাখা। ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রায় ৪৫০ জন কিশোর-তরুণ এতে অংশ নেন। দিনব্যাপী এ আয়োজনে ছিল সাহিত্য, সাংবাদিকতা, চলচ্চিত্র, আলোকচিত্র, উদ্দীপনামূলক বক্তব্য ও সাংস্কৃতিক আয়োজন। লিখেছেন মুসাব্বির হুসাইন

অনেক অনেক ধৈর্য থাকতে হবে

এটা কোরো না, ওটা কোরো না...নানা বাধায়, সমাজের চাপে পিষ্ট হয়ে এভাবেই অনেক প্রতিভা প্রকাশিত হওয়ার আগেই ঝরে পড়ে। ‘জীবনের জয়গান: ঢাকা পর্ব’তে ক্যারিয়ারবিষয়ক কর্মশালার শুরুতে এ কথা বলছিলেন বিপণন বিশেষজ্ঞ ও চিত্রনাট্যকার সৈয়দ গাউসুল আলম। কিশোর বয়সে তিনি নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে খুব একটা ভাবেননি, কিন্তু তিনি বর্তমান প্রেক্ষাপটে কিশোর-তরুণদের নিজেকে প্রস্তুত রাখার কথা বলেন। 

ক্যারিয়ার নিয়ে সমাজে প্রচলিত ভুল ধারণা সম্পর্কে সৈয়দ গাউসুল আলম বলেন, ‘একজন মানুষ একসঙ্গে অনেক কিছু করতে চাইতে পারে। এতে দোষের কিছু নেই। জীবনে একটা লক্ষ্যই থাকতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। মানুষ সবকিছুই করতে পারে, যদি একটা গুণ সে নিজের ভেতর আনতে পারে। তা হলো ধৈর্য। সফল হতে হলে অনেক অনেক ধৈর্য থাকতে হবে। কারণ, ধৈর্য দিয়ে এই পৃথিবীর সবকিছু জয় করা সম্ভব বলে অন্তত আমি বিশ্বাস করি।’ 

তরুণদের উদ্দেশে গাউসুল আলম বলেন, ‘বিশ্বাস রাখো তুমিই ভবিষ্যৎ। কারণ, পৃথিবীর সবচেয়ে তরুণ প্রজন্মসমৃদ্ধ জাতি হলো বাংলাদেশ। আর এই তারুণ্য খুবই বড় শক্তি, যা বিশ্ব বদলে দিতে পারে। নিজেকে কোনোভাবেই ছোট ভাবা যাবে না।’ 

আয়মান সাদিক স্বপ্নের কথা প্রকাশের আহ্বান জানিয়েছেন
আয়মান সাদিক স্বপ্নের কথা প্রকাশের আহ্বান জানিয়েছেন

এরপর প্রশ্নোত্তর পর্বে তরুণদের প্রশ্নের জবাব দেওয়ার মাধ্যমে সৈয়দ গাউসুল আলম কর্মশালা শেষ করেন। 

‘না’–কে ‘না’ বলতে জানতে হবে

তারুণ্যের জয়গান ঢাকা পর্বে আলোকচিত্রবিষয়ক কর্মশালা করিয়েছেন প্রীত রেজা। জীবনে সফল হতে কতটুকু গুরুত্ব দিয়ে কাজ করতে হবে, সে কথা বলছিলেন তরুণদের উদ্দেশে। তিনি বলেন, ‘আমার পছন্দের শব্দ হলো “না”। ছোটবেলা থেকে সবচেয়ে বেশিবার “না” শব্দটা শুনেছি আমরা। তাই এখন “না”–কে “না” বলতে জানতে হবে।’ 

সঙ্গ বা বন্ধু বাছাইয়ের ক্ষেত্রে কার সঙ্গে মিশছি, সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন প্রীত রেজা। নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা টেনে এনে বলেন, মধ্যবিত্ত পরিবারে ফটোগ্রাফার হতে চাওয়াটাও পাপ। আর এ জন্য নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে হবে। 

‘বর্তমান তরুণেরা স্রোতে গা ভাসান অনেক সময়। কাউকে কোনো কাজ করতে দেখলে সেটা অনুসরণ করা যেন খুব স্বাভাবিক। আপনি যেটাকে ট্রেন্ড মনে করছেন, নিজেকে সেই ট্রেন্ডের জন্য প্রস্তুত করতে করতে ট্রেন্ডটাই তো উধাও হয়ে যাবে! তাই কোনো ট্রেন্ডকে অনুসরণ করবেন না। এটা একটা ফাঁদ। নিজেই ট্রেন্ড তৈরি করুন। আরেকজনকে প্রশ্ন করতে চাইলে আগে নিজেকে প্রশ্ন করতে হবে। আমাদের হাত ধরেই আসবে পরিবর্তন। আমরা বলব আমরা “কী” হয়ে “কী” করব।’ 

এ ছাড়া ফটোগ্রাফি সম্পর্কে বিভিন্ন পরামর্শ দেন প্রীত রেজা। 

বক্তব্য দিচ্ছেন সৈয়দ গাউসুল আলম
বক্তব্য দিচ্ছেন সৈয়দ গাউসুল আলম

পৃথিবী যেন আমাকে মনে রাখে

রেদওয়ান রনি, একজন সফল চলচ্চিত্রনির্মাতা। কিশোর-তরুণদের শুনিয়েছেন নিজের জীবনের গল্প। বলেছেন নিজের স্বপ্নের কথা—ছবি তৈরির মধ্য দিয়ে তিনি পৃথিবীকে গল্প বলে যেতে চান যিনি, যেন পৃথিবী তাঁকে মনে রাখে। ক্যারিয়ার বিষয়ে নতুন পেশাগুলো সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য, ‘যেকোনো পেশা শুরুর ক্ষেত্রে মাথায় রাখতে হবে, সামনে কঠিন সময় আসছে। তাই পরিশ্রম করে যেতে হবে, হাল না ছেড়ে। কারণ, আপনি যে কাজই করুন না কেন, চেষ্টা করবেন সবচেয়ে ভালোটা করার।’ 

রেদওয়ান রনি আরও বলেন, ‘আমি টানা তিন বছর নিজের পেশার পেছনে পরিশ্রম করে গেছি। ফিল্ম তৈরি খুবই কঠিন একটা জায়গা। তাই আমি সব সময় নিজের সেরাটা দিতে প্রস্তুত ছিলাম।’ 

কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েও রেদওয়ান রনি বেছে নিয়েছিলেন চলচ্চিত্রকে। তাঁর বন্ধুরা চাকরি পেয়ে গিয়েছিলেন তত দিনে। তিনি তখন শিখছিলেন চলচ্চিত্র নির্মাণ। ‘জীবনের এই সময়ে আমি নিজের ওপর বিশ্বাস রেখেছি। কারণ, আমি জানতাম আমি পারব’, বলেন তিনি। 

সবশেষে রেদওয়ান রনি সহিংসতা ও উগ্রবাদ বিষয়ে বলেন, ‘যখন আপনি নিজের স্বপ্নের পেছনে ছুটবেন, কিছু করতে চাইবেন দেশ আর সমাজ নিয়ে; তখন সহিংসতা অনেক দূরে চলে যাবে। আর ছবি তৈরির মতো সৃজনশীল কাজ উগ্রবাদের বিরুদ্ধে কথা বলে।’ 

রেদওয়ান রনি
রেদওয়ান রনি

স্বপ্ন প্রকাশ করতে হবে

‘আমরা যদি স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে প্রতিদিন কাজ করি, তাহলে তো কোনো খারাপ চিন্তা মাথায় আনার সময়ই পাব না। যেমন সাকিব আল হাসান কখনো ভাববেন না তাঁর কোন বন্ধু আজকে মুভি দেখতে গেলেন, কিন্তু তিনি যেতে পারলেন না। তো কী হয়েছে? তাঁর সামনে ম্যাচ। আরেকটা সেঞ্চুরি। এসব চিন্তা করার সময় আছে?’ বলছিলেন টেন মিনিট স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আয়মান সাদিক। 

আয়মান মনে করেন, ‘আমাদের প্রত্যেকেরই নিজের স্বপ্নের কথা বলা উচিত। সবারই স্বপ্ন আছে, কিন্তু আমরা সেটা বলি না। ভয় পাই। ভাবি, মানুষ কী বলবে! আমরা মনে করি, শোনার পর যদি আমাকে নিয়ে কেউ মজা করে! কিন্তু যদি না-ই বলি, তাহলে স্বপ্নটা স্বপ্নই থেকে যায়।’ 

প্রীত রেজা
প্রীত রেজা

সময়ের সঙ্গে সংবাদপত্র

সাংবাদিকতা নিয়ে তরুণদের সঙ্গে কথা বলেন প্রথম আলোর ফিচার সম্পাদক সুমনা শারমীন। শুরুতেই বলেন, যদি কেউ বাংলাদেশকে জানতে চায়, তাহলে তাকে সংবাদপত্র পড়তে হবে। পত্রিকা সময়ের দলিল, যা তার পাঠককে এগিয়ে রাখে। সময়ের সঙ্গে নিজেকে গড়ে তোলার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হলো সংবাদপত্র। 

সুমনা শারমীন মনে করেন, সাংবাদিকতা খুবই দায়িত্বপূর্ণ পেশা। একই সঙ্গে কঠিনও। কারণ, একজন সাংবাদিককে বুঝতে হয় পাঠকের মন। ঘটনাকে দেখতে হয় পাঠকের নজরে এবং তা অনুভব করতে হয়। 

সুমনা শারমীন সাংবাদিকদের নিয়ে শোনান নানান গল্প, যেগুলো জানান দেয় সাংবাদিকদের নিজ পেশার প্রতি দায়িত্ববোধের কথা। যেমন ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় উপস্থিত ছিলেন প্রথম আলোর দুজন সাংবাদিক। যাঁরা তাৎক্ষণিকভাবেই ঘটনার মানসিক আঘাত থেকে বেরিয়ে এসে খবর সংগ্রহ করতে শুরু করেন। কারণ তাঁরা জানতেন, এই খবর মানুষের কাছে পৌঁছানোর দায়িত্ব তাঁদের। 

বেশি বেশি বই পড়তে হবে

তারুণ্যের জয়গান ঢাকা পর্বে লেখালেখির ওপর কর্মশালা নেন কথাসাহিত্যিক ও কিশোর আলোর সম্পাদক আনিসুল হক। তিনি বলেন, প্রতিভা হচ্ছে খুব ভালো লাগা, নিজের লক্ষ্য নির্ধারণ করা, দমে না যাওয়া, চর্চা করে যাওয়া, এগিয়ে যাওয়া। এভাবেই প্রতিভা বেরিয়ে আসতে থাকে। ভালো লেখক হতে হলে বেশি বেশি বই পড়তে হবে, বেশি বেশি লিখতে হবে, লেখা যেমনই হোক, থেমে যাওয়া যাবে না। ভালো–খারাপ সব ধরনের লেখাই পড়তে হবে। 

আনিসুল হকের সফল যদি হতে চাও বইটিতে সেই সূত্রই বলা হয়েছে। উপস্থিত তরুণদের মধ্য থেকে তিনি মঞ্চে ডেকে নেন বেশ কয়েকজনকে। উত্তর দেন লেখালেখি–সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রশ্নের। তিনি বলেন, ‘আমরা সবাই দেশের সম্পদ। আমরা দেশকে রক্ষা করব। স্বপ্ন দেখতে হবে যে আমরা বাংলাদেশকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দেশ বানাব। নির্ধারিত লক্ষ্য অনুযায়ী কাজ করে যাব। সফল আমরা হবই।’