ব্যাচতুতো বন্ধু

এসএসসি ০৬–এইচএসসি ০৮ গ্রুপের বন্ধুরা আয়োজন করেছিলেন মিলনমেলার। সেই আয়োজনে তোলা একটি ছবি। ছবি: সংগৃহীত
এসএসসি ০৬–এইচএসসি ০৮ গ্রুপের বন্ধুরা আয়োজন করেছিলেন মিলনমেলার। সেই আয়োজনে তোলা একটি ছবি। ছবি: সংগৃহীত
এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার বছর ধরে সারা দেশের তরুণেরা ফেসবুকের মাধ্যমে এক হয়ে উদ্‌যাপন করছেন বন্ধুত্ব। স্রেফ আনন্দই নয়, বাস্তবে সামাজিক নানান দায়িত্বও তাঁরা পালন করছেন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। আগামীকাল রোববার বন্ধু দিবস। তাই ফেসবুকের তেমন কিছু গ্রুপ আর বন্ধুত্বের জয়গান নিয়ে এবারের প্রতিবেদন।

তৃণা ক্যানসারের সঙ্গে বসবাস করছেন। তবে এই রোগটা জয় করে ফিরলে রাঙামাটিতে তিনি একটা বিশাল ভোজের আয়োজন করে ফেলবেন। সেখানে নিমন্ত্রিতদের মধ্যে থাকবেন ২০০৫ সালে যাঁরা এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিলেন। ২০০৭ সালে যাঁরা এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছিলেন, তাঁরাও থাকবেন। এই দুই বর্ষের পরীক্ষার্থীরা তৃণার বন্ধু। সারা দেশ থেকে সবাই নিমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে রাঙামাটিতে হাজির হলে কী অভাবনীয় এক ব্যাপারই না হবে! তৃণা নিশ্চয়ই তাঁর দুই সন্তানকে বলবেন, ‘এই দেখো, এরা সবাই তোমাদের খালা আর মামা—আমার বন্ধু! আমার সেরে ওঠার পেছনে ওদেরও ভূমিকা আছে।’

তৃণা, যাঁর পুরো নাম মোরশেদা ইসলাম, কাউকে এমন কথা দেননি। কিন্তু বন্ধুদের যে ভালোবাসা তিনি পেয়েছেন, জীবনের ভীষণ সংকটে যেভাবে সবাই এগিয়ে এসেছে, তাতে করে এমন কিছু হলেও তো হতে পারে। তৃণা শিক্ষকতা করেন রাঙামাটিতে। সেখান থেকেই এসএসসি পাস করেছেন ২০০৫ সালে, ২০০৭ সালে এইচএসসি। গত ৩১ জুলাই ভারতে গেছেন পঞ্চমবারের মতো কেমোথেরাপি নিতে। এর আগে আরও তিনবার ভারতে কেমোথেরাপি নিয়েছেন, একবার বাংলাদেশে। পঞ্চমবারে আর কুলিয়ে উঠতে পারছিলেন না। দরকার ছিল প্রায় ৪ লাখ টাকা। ক্যালেন্ডার চোখ রাঙাচ্ছিল প্রতিনিয়ত। বলবেন কি বলবেন না করে শেষমেশ বন্ধুদের হাত বাড়িয়ে দিতে বলেছিলেন তৃণা। যুক্ত ছিলেন ফেসবুকের ‘এসএসসি ০৫–এইচএসসি ০৭’ গ্রুপের সঙ্গে। সেখানেই সসংকোচে বলেছিলেন নিজের সংকটের কথা।

এসএসসি ০৫–এইচএসসি ০৭ গ্রুপের সদস্যদের কয়েকজন। ছবি: সংগৃহীত
এসএসসি ০৫–এইচএসসি ০৭ গ্রুপের সদস্যদের কয়েকজন। ছবি: সংগৃহীত

ফেসবুক গ্রুপটির অন্যতম সদস্য মাহমুদুল হাসান বলছিলেন, ‘১৫ দিনের মাথায় আমরা তৃণার হাতে প্রয়োজনীয় টাকা তুলে দিতে পেরেছি। এ মাসের ৪ বা ৫ তারিখে ও চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করবে। তারপর কেমোথেরাপি নেবে। ওর সঙ্গে আমাদের কথা হওয়ার পরপরই প্রয়োজনীয় তথ্য চেয়েছিলাম। আমাদের গ্রুপে অনেক চিকিৎসক বন্ধু আছে, ওরা সব যাচাই করে দেখল।

‘রাঙামাটির বন্ধুদের বলা হলো, ওর পরিবারের সঙ্গে কথা বলতে। সব মিলিয়ে আমরা নিশ্চিত হলাম, আসলেই তৃণার সহযোগিতা প্রয়োজন। ফেসবুকে ইভেন্ট খুলে সারা দেশের বন্ধুদের সহযোগিতার জন্য হাত বাড়াতে বলা হলো। তৃণার জন্য চার দিনেই জোগাড় হলো প্রায় ৩ লাখ টাকা। ২০১৮ সালের মার্চ মাসে ফেসবুক গ্রুপটি খুলেছি আমরা। গ্রুপে এখন প্রায় ৪৪ হাজার সদস্য। গ্রুপের সূত্রে বাস্তবে আমরা প্রায়ই একত্র হই। এই যেমন হলাম তৃণার জন্য। ভবিষ্যতে আরও বৃহৎ পরিসরে বন্ধুত্ব উদ্‌যাপন করতে চাই আমরা।’

কক্সবাজার ভ্রমণে এসএসসি–০৬–এইচএসসি–০৮ গ্রুপের সদস্যরা
কক্সবাজার ভ্রমণে এসএসসি–০৬–এইচএসসি–০৮ গ্রুপের সদস্যরা

বন্ধুত্বের হয় না তুলনা

কেবল সংকট নয়, মামুলি সব বিষয়–আশয়ও ভাগাভাগি হয় এই গ্রুপগুলোতে। যেমন এসএসসি ০৪–এইচএসসি ০৬ গ্রুপে দেখা গেল এক সদস্য দুটি শার্টের ছবি তুলে দিয়ে লিখেছেন, ‘কেউ একটু হেল্প কর। এই সাইট থেকে শার্ট দুটি নিতে চাচ্ছি। রিভিউ কেমন বা কেউ এখান থেকে নিছিস? ক্যামনে কিনব সেটাও জানি না। কেউ একটু জানা, ভাই।’ গ্রুপগুলোর মজা এখানেই। অধিকাংশেরই আগে পরিচয় থাকে না, কিন্তু কথার শুরুই হয় ‘তুই–তোকারি’ দিয়ে। ব্যাচতুতো ভাইদের জন্য ছাড়েরও কমতি নেই। ছাড় বলতে আক্ষরিক অর্থেই ছাড়। নিজের বার্গারের দোকানে একই ব্যাচের বন্ধুদের জন্য কেউ হয়তো দিয়ে বসে ৩০ শতাংশ ছাড়; কেউ হয়তো ৪০ শতাংশ ছাড়ের ঘোষণা দেয় নিজের রিসোর্টে।

এ ধরনের গ্রুপের শুরুটা যে কোথায়, তার কোনো গাছপাথর নেই। গ্রুপগুলোতে যোগ দেওয়ার শুরুতে নামধাম আর এসএসসি পরীক্ষার রোল নম্বর দেওয়ার নিয়ম। সব ঠিক থাকলে গ্রুপের অ্যাডমিনদের সুবজসংকেত মিললেই একেকজন যেন ছোট খালবিল আর নদী থেকে গিয়ে পড়ে সমুদ্রে। যে সমুদ্রে দিনমান সাঁতার কাটে সারা দেশের একই ব্যাচের বন্ধুরা। আড্ডা চলে রাতদিন। ভার্চ্যুয়াল আড্ডা গড়ায় বাস্তবের মাটিতে। সব গ্রুপই এখন বেশ সক্রিয়। তার মধ্যে অন্যতম এসএসসি ০২–এইচএসসি ০৪ ব্যাচের গ্রুপটি। ২০১২ সালে এর গোড়াপত্তন। এই গ্রুপের অ্যাডমিনদের একজন জাকারিয়া নাহিদ বললেন, ‘স্কুল–কলেজের বন্ধুদের অনেকের সঙ্গেই একটা সময় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যখন অনেকেই হারিয়ে যাওয়া বন্ধুদের খুঁজে বের করছে, তখন সারা দেশের বন্ধুদের সঙ্গে পরিচিত হতেই গ্রুপটির শুরু। এখন প্রায় ৪০ হাজার সদস্যের বিশাল প্ল্যাটফর্ম এটি।’

অসহায় শিশুদের হাতে নতুন পোশাক তুেল দিচ্ছেন এসএসসি ০২–এইচএসসি ০৪ ব্যাচের সদস্যরা।
অসহায় শিশুদের হাতে নতুন পোশাক তুেল দিচ্ছেন এসএসসি ০২–এইচএসসি ০৪ ব্যাচের সদস্যরা।

বন্ধুত্বের শক্তি
বিশাল প্ল্যাটফর্মগুলোকে তাঁরা লাগাচ্ছেন নানান ইতিবাচক কাজে। বেকার বন্ধু বা স্বজনদের চাকরির ব্যবস্থা করা, বিনা মূল্যে জরুরি রক্তের প্রয়োজনে ছুটে যাওয়া, প্রয়োজনীয় সামগ্রী দেশের বাইরে থেকে নিয়ে বা দিয়ে আসার কাজটি সহজেই হয়ে যাচ্ছে গ্রুপ পোস্টের মাধ্যমে। দল বেঁধে আবার বেরিয়ে পড়ছেন ভ্রমণে; বনভোজন, ক্রিকেট টুর্নামেন্ট, কনসার্ট, ইফতার পার্টি বা পিঠা উৎসবের মতো আয়োজনও হচ্ছে নিয়মিত। গত তিনটি ঈদের আগে এসএসসি ০২–এইচএসসি ০৪ গ্রুপের সদস্যরা দেশজুড়ে পথশিশুদের নতুন জামা উপহার দেওয়ার জন্য ‘সাইলেন্ট স্মাইল’ নামের এক চমৎকার আয়োজন করেছেন। এবারও করছেন। কেবল দেশেই নয়, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে আরব আমিরাতের বন্ধুরা স্বেচ্ছায় রক্তদানও করেছেন। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের স্কুলসামগ্রী বিতরণ, বৃক্ষরোপণ অভিযান, ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্পসহ নানান ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগে দুস্থদের পাশে থাকছেন সবাই মিলে।

‘একতাই সাহস, একতাই শক্তি’—এই মূলমন্ত্র নিয়ে ২০১৮ সালে এসএসসি ০৬–এইচএসসি ০৮ গ্রুপের যাত্রা শুরু। বছর না ঘুরতেই নানান ধরনের জনহিতকর কাজ করেছেন এর সদস্যরা। এই তো আজকালের মধ্যেই যাচ্ছেন গাইবান্ধায় বন্যার্তদের ত্রাণ দিতে। গ্রুপটির সদস্য শাওন খান বলছিলেন ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা, ‘আমরা একটি কল্যাণ তহবিল গঠন করার চিন্তা করছি। পথশিশুদের জন্য স্কুল এবং বয়স্ক মানুষের জন্য প্রবীণনিবাস তৈরির পরিকল্পনাও আছে। চিকিৎসাসেবা পায় না এমন মানুষের জন্য হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করাও আমাদের স্বপ্ন। এসব সত্যি করা খুব সম্ভব। কারণ, বন্ধুত্বের শক্তি প্রচণ্ড, এটা আমরা বাস্তবে দেখেছি।’

শেষ বাক্যটি সব গ্রুপের সদস্যই মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন। তাই সংগীতশিল্পী তপুর গানে গলা মেলাতে পারেন সবাই, ‘তোরা ছিলি তোরা আছিস/ জানি তোরাই থাকবি/ বন্ধু—বোঝে আমাকে/ বন্ধু আছে আর কী লাগে?’

ফেসবুকের বাইরেও ব্যাচতুতো বন্ধুত্ব
ফেসবুক–প্রজন্মের আগেও ব্যাচতুতো বন্ধুত্বের একাধিক সংগঠন গড়ে উঠেছে দেশে। ‘ঢাবি ৮৩ ব্যাচ ফাউন্ডেশন’ সেগুলোর অন্যতম। রীতিমতো নিবন্ধিত এই সংগঠনটি এগিয়ে নিচ্ছেন এম এম ফজলুল হক। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কমিশনার (কর) তিনি। হাজারো ব্যস্ততায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৮৩ ব্যাচের বন্ধুদের এক সুতোয় গেঁথে রাখছেন। বয়স তো কম হলো না, জীবনের মাঠে অর্ধশতক হাঁকিয়েছেন অধিকাংশ সদস্য। দেশের বড় বড় পদে, গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ একেকজন। তারপরও নিয়ম করে আড্ডা, সহযোগিতা আর সামাজিক কর্মকাণ্ড চলছে ২০০৮ সাল থেকে। ফজলুল হক বলছিলেন, ‘আমাদের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৬টি বিভাগ ছিল। সব ডিপার্টমেন্টের বন্ধুরা এই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত আছেন। স্বেচ্ছায় রক্তদান থেকে শুরু করে শিক্ষার্থীদের বৃত্তি, ভ্রমণ, সাময়িকী প্রকাশসহ নানান ধরনের কাজ করছি আমরা। বন্ধুত্ব বিষয়টি অনবদ্য। একে–অপরের সঙ্গে থাকাই আমাদের ব্রত।’