কাছের পুরুষেরাই 'হুমকি'

অলংকরণ : মাসুক হেলাল
অলংকরণ : মাসুক হেলাল

গত বছরের নভেম্বর মাসে ৩৮ বছর বয়সী এক যুবকের সঙ্গে বিয়ে হয়। ২৬ বছর বয়সী স্ত্রী বিয়ের পর ভালো ছিলেন মাত্র তিন মাস। এরই মধ্যে স্ত্রী জানতে পারেন, তাঁর স্বামী আগে বিয়ে করেছিলেন। তিনটি সন্তানও আছে। এ নিয়েই শুরু হয় অশান্তি। ওই নারী জানতে পারেন, তাঁদের দাম্পত্য জীবনের বিভিন্ন মুহূর্তের ছবি ফেসবুকে ছেড়ে দিয়েছেন স্বামী। গত ১১ জুন তাঁর স্বামীর বিরুদ্ধে খিলগাঁও থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন। 

রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএর শেষ বর্ষের ছাত্রীর একই বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রের সঙ্গে পরিচয়। তিন বছর আগে তাঁদের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং তা শারীরিক সম্পর্ক পর্যন্ত গড়ায়। কিন্তু ওই যুবক শারীরিক সম্পর্কের সময় গোপনে তা ভিডিওতে ধারণ করতেন। এরপর ওই ভিডিওর অজুহাতে বারবার শারীরিক সম্পর্ক করতে বাধ্য করেন। একপর্যায়ে তরুণী আর সম্পর্ক না রাখতে চাইলে ওই ভিডিও ফেসবুকে ছেড়ে দেওয়ার হুমকি দেন ওই প্রেমিক। শুধু তা–ই নয়, ভিডিও তরুণীর পরিবারের কাছে পাঠিয়ে দেন। গত ১০ জুলাই ওই যুবকের বিরুদ্ধে রাজধানীর হাজারীবাগ থানায় মামলা করেছেন ওই তরুণী।

সাইবার ট্রাইব্যুনালের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) নজরুল ইসলাম বলেন, সাইবার অপরাধের শিকার ৭০ শতাংশ ভুক্তভোগী হলেন নারী। এই নারীদের অনেকেই স্কুলসহ বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষার্থী। গৃহবধূসহ বিভিন্ন স্তরের নারীরাও আছেন। প্রেমের সম্পর্কের ফাঁদে ফেলে তরুণীদের গোপন ভিডিও ধারণ করছেন কথিত প্রেমিকেরা। সম্পর্কের অবনতি হওয়ার পর তা ইন্টারনেটে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। একইভাবে দাম্পত্য জীবনের গোপন দৃশ্য ধারণ করছেন অনেক স্বামী। সম্পর্কে ফাটল ধরার পর সেই ভিডিও ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দিচ্ছেন। 

ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালের সাধারণ নিবন্ধন খাতার তথ্য বলছে, এই ট্রাইব্যুনালে বর্তমানে ১ হাজার ৫২৩টি মামলা বিচারাধীন। ট্রাইব্যুনালটির পেশকার শামীম আল মামুন জানান, এসব মামলার মধ্যে অন্তত ৭০০ মামলার ভুক্তভোগী নারী। এই ধরনের অপরাধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা করছেন ভুক্তভোগীরা। তবে ভুক্তভোগীরা বলছেন, বিচারের দীর্ঘসূত্রতাসহ সামাজিক বিভিন্ন কারণে একটা পর্যায়ে মামলায় আপস করতে বাধ্য হচ্ছেন।

প্রথম আলোর পক্ষ থেকে নারীর অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিও ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগে করা ৭০টি মামলার কাগজপত্র পর্যালোচনা অনুযায়ী, সাইবার অপরাধের শিকার বেশির ভাগ নারীর বয়স ১৬ থেকে ৪০–এর মধ্যে। এই ভুক্তভোগী নারীরা অভিযোগ করেছেন একসময়ের কাছের মানুষের বিরুদ্ধে। মামলা করা নারীরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। একদম শেষ পর্যায়ে ভুক্তভোগী নারী আইনের আশ্রয় নিতে আসেন। 

সম্প্রতি ঢাকার আদালত চত্বরে ভুক্তভোগী এক তরুণী বলেন, অন্তরঙ্গ মুহূর্তের গোপন ভিডিও বা ছবি ছেড়ে দেওয়াসংক্রান্ত ঘটনার বিচার চাইতে গিয়ে নানাভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এই তরুণী রাজধানীর একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। গত ১৭ জুলাই ওই প্রেমিক যুবক ঢাকার আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

গাইবান্ধার ১৮ বছর বয়সী এক তরুণীর স্থানীয় এক যুবকের সঙ্গে ছয় বছর আগে বিয়ে হয়। বিয়ের পর তিনি স্বামীকে তালাক দেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে দাম্পত্য জীবনের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি ইন্টারনেটে ছেড়ে দেন তাঁর সাবেক স্বামী। 

 রাজধানীর আরেকটি ঘটনায় স্বামী নিজের শাশুড়ির গোসল করার ভিডিও করে তা স্ত্রীর মুঠোফোনে পাঠিয়ে দেন। স্বামীর পাঠানো এ দৃশ্য সহ্য করতে না পেরে ওই নারী গত ২৭ মে আত্মহত্যা করেন। বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সাবেক নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী বলেন, ভুক্তভোগী নারীদের বিচার চাইতে গিয়ে চরম অপমানজনক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। এ কারণে অনেক ভুক্তভোগী নারী আইনের আশ্রয় নিচ্ছেন না। ক্যামেরা ট্রায়ালের মাধ্যমে বিচার নিশ্চিত করতে হবে। 

সাইবার অপরাধ নিয়ে কাজ করা সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বললেন, একসময়ের কাছের পুরুষ নারীর জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠছেন। ভুক্তভোগী নারীরা কল্পনাও করেননি, তাঁদের কাছের মানুষ অন্তরঙ্গ মুহূর্তের দৃশ্য গোপন ভিডিও ধারণ করবেন। নারীকে বশে আনার জন্য সেই ভিডিওকে বড় অস্ত্র বানাবেন। এই ধরনের অপরাধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতের বিষয়টিতে গুরুত্ব দিলেন এ আইনজীবী। 

ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্র্যান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) আ ফ ম আল কিবরিয়া বললেন, সম্পর্ক জড়ানোর সময় অন্তরঙ্গ মুহূর্তের দৃশ্য ধারণের ব্যাপারে নারীকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। ঘটনার শিকার হওয়ার পর সঙ্গে সঙ্গে আইনের আশ্রয় নিতে হবে। কারণ, যত দিন গড়ায় ততই আলামত নষ্ট হতে থাকে।