মোটরসাইকেল দাপিয়ে বেড়ান ফয়জুন

ফয়জুন নেছা
ফয়জুন নেছা

মফস্বল শহরে মোটরসাইকেল দাপিয়ে বেড়ান ফয়জুন নেছা। এলাকায় সবাই তাঁকে মনা নামেই চেনেন। মা-বাবাকে চিকিৎসক দেখানো, নিজের কর্মস্থলে যাওয়া বা নিজের ছোট মেয়েদের বিভিন্ন খেলার প্রশিক্ষণ দিতে এখানে-সেখানে নিতেও ফয়জুনের এই মোটরসাইকেলই ভরসা।

লালমনিরহাট জেলার হাতীবান্ধা উপজেলার সিংগীমারী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ফয়জুন নেছা। শুরুর দিকে এই ফয়জুন বা মনা যখন মোটরসাইকেল নিয়ে বের হতেন, তখন মানুষ বলত, ‘ওই যে ছেলে বা হিজড়া যাচ্ছে।’ কেউবা নাম দিয়েছিলেন উচ্ছৃঙ্খল বেপরোয়া মেয়ে। সবকিছু উপেক্ষা করে স্কুল, কলেজ পেরিয়ে অতীশ দীপঙ্কর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ ও এমবিএ শেষ করেন ফয়জুন। সম্প্রতি হাতীবান্ধায় গিয়ে কথা হয় ফয়জুনের সঙ্গে। তিন ভাই, দুই বোনের মধ্যে ফয়জুন সবার ছোট।

ফয়জুনদের বাড়ির সামনে বড় গাছের নিচে মানুষ মোটরসাইকেল রাখতেন। প্রথমে বিরক্ত হলেও পরে মোটরসাইকেলে বসে বন্ধুদের ঠেলতে বলতেন ফয়জুন। আস্তে আস্তে মোটরসাইকেলের প্রতি আগ্রহ জন্মায়। মেয়ের আগ্রহ দেখে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বাবা ফজলুল হক মোটরসাইকেল কেনেন। মেয়ে আর বাবা একসঙ্গে মোটরসাইকেল চালানো শেখেন। বাবা স্কুল থেকে ফিরলেই মোটরসাইকেল নিয়ে এ পাড়া-ও পাড়া ঘুরে বেড়ানো, বাড়ির বাজার করাসহ সব কাজ সারতেন ফয়জুন। 

ফয়জুন বললেন, স্কুলের শিক্ষকতা থেকে অবসর নেওয়ার পর ২০০৫ সালে বাবার শরীর অবশ হওয়া থেকে শুরু করে নানান জটিলতা দেখা দিতে শুরু করে। অসুস্থ বাবাকে মোটরসাইকেলে বসিয়েই হাসপাতালে ছুটতে হয়। চিকিৎসকেরা অনেকবার বলেছেন, বাবাকে দ্রুত হাসপাতালে না নিতে পারলে বড় দুর্ঘটনার আশঙ্কা ছিল। 

ফয়জুন নিজে মোটরসাইকেল চালানো শিখেই থেমে যাননি। অনেককে বিনা মূল্যে প্রশিক্ষণও দিচ্ছেন। 

 ছোটবেলা থেকেই ফয়জুন খেলার জন্য স্কুলে বিভিন্ন পুরস্কার পাওয়ার পাশাপাশি দুবার জাতীয় পর্যায়েও পুরস্কার পান। তবে খেলার ক্ষেত্রে বেশ বৈরী পরিবেশ তৈরি করেন পরিবারের সদস্যরা। নিজের মুঠোফোন বিক্রি করে সাভারের বিকেএসপিতে ফুটবল প্রশিক্ষণের জন্য এসেছিলেন একবার। কিন্তু পরিবারের চাপে তাঁকে ফিরে যেতে হয়েছিল। 

ফয়জুন আক্ষেপ করে বললেন, ‘ওভাবে আমাকে ফিরে যেতে না হলে আমি হয়তো এত দিনে নারী জাতীয় ফুটবল দলে থেকে দেশের প্রতিনিধিত্ব করতে পারতাম।’

২০১৩ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়ে শিক্ষকতার ফাঁকে ফাঁকে ফয়জুন স্কুলের মেয়েদের সংগঠিত করতে থাকেন। মানচিত্র স্পোর্টস ক্লাব নামের একটি দল গঠন করেছেন। এ দলে সদস্য আছে ৩০-৩৫ জন। এই দলের জন্য ফয়জুন প্রতিদিন আলাদা করে সময় বের করেন। দলের কোনো সদস্য জাতীয় পর্যায়ে খেলতে গেলে তাকে নিজের খরচেই ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যান ফয়জুন। হাতীবান্ধার বিভিন্ন স্কুলের খেলার মাঠে মেয়ে খেলোয়াড়দের প্রশিক্ষণ দেন। মেয়েদের খেলার পোশাক, নাশতাসহ নানা আনুষঙ্গিক খরচ তাঁর বেতনের টাকা থেকেই খরচ করেন। ফয়জুন বললেন, ‘এই মেয়ে খেলোয়াড়দের মধ্যে আমি আমাকে খুঁজে পাই। তারা ভালো করলে আমার ভালো লাগে। এই মেয়েরা জাতীয় পর্যায়ে সফল হলে আমার স্বপ্ন পূরণ হবে।’

হাতীবান্ধার শাহ গরিবুল্লাহ মাধ্যমিক বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তবিবর রহমান বললেন, ‘ফয়জুন খুব সাহসী নারী। তাঁর মোটরসাইকেল চালানো দেখে অনেক মেয়ে মুগ্ধ হয়। আমাদের স্কুলের মাঠে মেয়েদের নানা খেলার প্রশিক্ষণ দেন। বর্তমান সমাজে তাঁর মতো নারীর দরকার। তাঁকে দেখে অন্যরা অনুপ্রাণিত হবে।’