রেফারি তাহমিনা

অনূর্ধ্ব-১৬ জাতীয় মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে তাহমিনা আক্তার। ছবি: শামসুল হক
অনূর্ধ্ব-১৬ জাতীয় মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে তাহমিনা আক্তার। ছবি: শামসুল হক

ছেলেদের ফুটবলে কিশোরী রেফারি! ব্যাপারটা অনেকেই বাঁকা চোখে দেখেন। অনেকে আবার ভাবেন, এটা কেমন কথা? পাড়া–প্রতিবেশীদের সমালোচনাও সইতে হয় কাউকে কাউকে। কিন্তু এসব জয় করেই প্রতিদিন মাঠে আসে তাহমিনা আক্তার। রাজধানীর এমারত হোসেন আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে পড়ছে সে। কিন্তু এইটুকু বয়সেই রেফারিংয়ের শখ পেয়ে বসেছে তাহমিনাকে।

একসময় স্বপ্ন দেখত চিকিৎসক হওয়ার। কিন্তু সেই স্বপ্ন মোড় নিয়েছে ফুটবল রেফারিংয়ে। বাবা রহিম মিয়ার চেহারা মনে নেই তাহমিনার। ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছে। সৌদি আরবে কর্মরত বাবা সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার পর তাহমিনার মা যেন অকূল দরিয়ায় পড়েছিলেন। মেয়েকে পড়াশোনা করিয়ে অনেক বড় মানুষ করবেন, সেই স্বপ্নই দেখেন। কিন্তু মেয়ে স্কুলে গিয়ে ফুটবল খেলত। কখনো ক্রিকেট ও ভলিবলও খেলেছে তাহমিনা। কিন্তু ফুটবল খেলতে খেলতেই ফেডারেশনের তালিকাভুক্ত রেফারি শহীদুল ইসলামের সঙ্গে পরিচয়। শহীদুলের অনুপ্রেরণাতেই সেই ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় ফুটবল রেফারিং শুরু করে। এ জন্য অবশ্য ফিফার বিভিন্ন রেফারি কোর্স করতে হয়েছে তাহমিনাকে।

এ পর্যন্ত রেফারিং ক্যারিয়ারে বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা স্কুল ফুটবল টুর্নামেন্টে ৪টি ম্যাচ পরিচালনা করেছে তাহমিনা। পাইওনিয়ার ফুটবল লিগে ছেলেদের ৩৯টি ম্যাচে ছিল প্রধান ও সহকারী রেফারির ভূমিকায়। এ ছাড়া জেএফএ কাপ অনূর্ধ্ব-১৬ নারী ফুটবলেও প্রায় ২০টি ম্যাচ পরিচালনা করেছে। শুধু তা–ই নয়, এর বাইরে আরেকটি পেশাতেও জড়িয়ে পড়েছে তাহমিনা। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ, চ্যাম্পিয়নশিপ লিগসহ বিভিন্ন ঘরোয়া টুর্নামেন্টের ম্যাচ এএফসির ওয়েবসাইট মাইকুজু ডট টিভিতে সরাসরি সম্প্রচার করে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন। সেই ম্যাচ ক্যামেরায় ধারণ করে তাহমিনা। এ জন্য প্রতিটি ম্যাচেই প্রেসবক্সে দেখা যায় তাহমিনার সরব উপস্থিতি।

প্রথম দিন ম্যাচ পরিচালনার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল? বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের প্রেসবক্সে বসে তাহমিনা বলল, ‘আমি প্রথম ম্যাচ পরিচালনা করি ২০১৬ সালে। সেটা ছিল বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা স্কুল ফুটবলের ম্যাচ। একটু নার্ভাস লাগছিল। কিন্তু অন্য আপুরা সাহস দিতেই ভয় কেটে যায়।’ ওই বছরই নীলফামারীতে রেফারিং করতে গিয়ে ঘটেছিল একটা বিব্রতকর কাণ্ড। ভুল সিদ্ধান্ত দিয়েছিল বলে ম্যাচ হেরে যাওয়ায় কোচ মাঠেই স্ট্রোক করেছিলেন। পরে অবশ্য সেই কোচ সুস্থ হতেই হাঁপ ছেড়ে বাঁচে তাহমিনা।

তাহমিনার স্বপ্ন ফিফা রেফারি হিসেবে দায়িত্ব পালনের। ছবি: সংগৃহীত
তাহমিনার স্বপ্ন ফিফা রেফারি হিসেবে দায়িত্ব পালনের। ছবি: সংগৃহীত

ফুটবল রেফারিংয়ে ক্যারিয়ার গড়তে চায় তাহমিনা। যদিও কাজটি কঠিন। কিন্তু তাহমিনা দেশ–বিদেশে আন্তর্জাতিক ম্যাচ পরিচালনার স্বপ্ন দেখছে। বাংলাদেশের রেফারি মিজানুর রহমানকে আদর্শ মানা তাহমিনা বলছিল, ‘বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত কোনো মেয়ে ফিফা রেফারি হতে পারেনি। আমি সেটা হতে চাই। এ জন্য নিজেকে আরও ভালোভাবে প্রস্তুত করতে হবে।’

রেফারিংয়ের পারিশ্রমিক নিয়ে খুব বেশি সন্তুষ্ট নয়। মাত্র ৬০০ টাকা পায় প্রতিটি ম্যাচ পরিচালনা করে। এর বাইরে ৬০০ টাকা দেওয়া হয় মাইকুজু টিভিতে ম্যাচ ভিডিও ধারণ করার পারিশ্রমিক হিসেবে। রাজধানীর দক্ষিণখানে তাহমিনার মায়ের একটা ছোট্ট কাপড়ের দোকান আছে। এর বাইরে উপার্জন বলতে তাহমিনার রেফারিংয়ের এই পারিশ্রমিক। মায়ের হাতে যা সামান্য টাকা তুলে দিতে পারে, তাতেই খুশি—‘আমি যেটুকু পারি মাকে সাহায্য করতে চাই। এই বয়সেই মাকে টাকা দিতে পেরে খুব ভালো লাগে।’

পেশাদার ফুটবলে নারী কোচ এরই মধ্যে পেয়ে গেছে বাংলাদেশের ফুটবল। মিরোনা খাতুন গত মৌসুমে চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে ঢাকা সিটি এফসিতে কোচের দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত পেশাদার ফুটবলের ম্যাচ পরিচালনা করেননি কোনো নারী রেফারি। সুইজারল্যান্ডের নারী রেফারি এস্তার স্তাওবালি গত ফিফা অনূর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপে ম্যাচ পরিচালনা করেছেন ভারতের যুবভারতী স্টেডিয়ামে। জার্মান বুন্দেসলিগার ইতিহাসে প্রথম নারী রেফারি হিসেবে বিবিয়ানা স্টেইনহস ম্যাচ পরিচালনা করেছেন। অবশ্য বাংলাদেশের জয়া চাকমা, সালমা আক্তারেরা এরই মধ্যে দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে এএফসি ও সাফের বেশ কিছু বয়সভিত্তিক ম্যাচ পরিচালনা করেছেন। সেই দিন বেশি দূরে নয়, যেদিন শুধু ছেলেরা নয়, তাহমিনাদের মতো মেয়েরাও আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচে বাঁশিতে ফুঁ দেবে।