বাইসাইকেল ওদের জীবন বদলে দিয়েছে

ছাত্রীরা বাইসাইকেল চালিয়ে বাড়ি িফরছে।  ছবি: প্রথম আলো
ছাত্রীরা বাইসাইকেল চালিয়ে বাড়ি িফরছে। ছবি: প্রথম আলো

ওই গাঁয়ের মেয়েদের শুধুই হাঁটতে হতো। ভ্যান–রিকশার খুব একটা প্রচলন ছিল না। দু-একটা বাড়িতে বাইসাইকেল ছিল। তা–ও ছেলেদের। মেয়েরা বাইসাইকেলে চড়ে কোথাও যাবে, দুই বছর আগেও তা কেউ কল্পনা করতে পারেনি।

সেই গাঁয়ের মেয়েরা এখন দল বেঁধে বাইসাইকেল চালিয়ে বিদ্যালয়ে যায়। বাইসাইকেলের বদৌলতে তাদের বিদ্যালয়ে আসা–যাওয়া এখন অনেক সহজ হয়েছে। তারা সময়মতো বিদ্যালয়ে উপস্থিত হতে পারে। এমনকি তারা শতভাগ উপস্থিতিও নিশ্চিত করেছে। পড়াশোনায় ভালো করছে। শিক্ষকেরা বলছেন, বাইসাইকেলই ওদের জীবন বদলে দিয়েছে।

বিদ্যালয়টির নাম ‘গুড়িহারী-কামদেবপুর আলোর পাঠশালা’। এটি নওগাঁ জেলার নিয়ামতপুর উপজেলার শালবাড়ি গ্রামে অবস্থিত। নিভৃত এলাকায় ২০১৬ সালে প্রথম আলো ট্রাস্ট এই বিদ্যালয়টি স্থাপন করেছে। আশপাশের প্রায় ১০টি গ্রামের মধ্যে এটিই একমাত্র মাধ্যমিক বিদ্যালয়। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নূর আলম জানালেন, ঢাকার ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল ‘সানিডেইল’–এর পক্ষ থেকে বাইসাইকেলগুলো দেওয়া হয়।

শুরুতে সাইকেলগুলো চালানোর ব্যাপারে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি ও এলাকার লোকজনের মতামত নেওয়া হয়েছে। মেয়েরা বাইসাইকেল চালিয়ে বিদ্যালয়ে আসবে, এ ব্যাপারে তখন কেউ আপত্তি করেননি। তবে নিয়ম করা হয়, পাস করে যাওয়ার পরে সাইকেলটি বিদ্যালয়ে জমা দিয়ে যেতে হবে। সেটি নতুন আরেকজন শিক্ষার্থীকে দেওয়া হবে। সিদ্ধান্ত হয়, যে মেয়েরা সবচেয়ে দূরের গ্রাম থেকে আসবে, যারা তুলনামূলক বেশি মেধাবী, তারা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সাইকেল পাবে। বাইসাইকেল পাওয়া শিক্ষার্থীরা এখন একসঙ্গে বাইসাইকেলে চড়ে বিদ্যালয়ে আসে। রাস্তায় কোনো মেয়েকে এখন আর কেউ ঝামেলা করে না বা করতে পারে না। এলাকার পরিবেশটাও পাল্টে গেছে। বিদ্যালয়টির মূল শিক্ষার্থী ১০৩ জন। এর মধ্যে মেয়ে ৫৭ জন। আর ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণির ৩০ জন মেয়ে সাইকেল চালাচ্ছে।

বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক নূর আলম বলেন, বিদ্যালয়ে প্রথমে যখন সাইকেল পাওয়া গেল, তখন বিদ্যালয়ের মাত্র একজন মেয়ে সাইকেল চালানো জানত। তার বাড়ি পানিশাইল গ্রামে। সে নিজের বাড়িতেই চড়া শিখেছিল। মেয়েটির নাম নূরজাহান খাতুন। বর্তমানে সে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। নূরজাহানই একে একে সব মেয়েকে সাইকেল চড়া শিখিয়েছে।

নূরজাহান জানাল, তার বাবার সাইকেল ছিল। বাবাই চড়তেন। বাবার সাইকেলেই সে চড়া শিখেছে। কিন্তু সাইকেল চড়ে বিদ্যালয়ে আসার মতো তার আলাদা কোনো সাইকেল ছিল না। পরিবেশও ছিল না। বিদ্যালয় থেকে যখন একসঙ্গে মেয়েদের সাইকেল দেওয়া হলো, তখন সে সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছে। তাকেও সাইকেল দেওয়া হয়েছে। এর আগে সাইকেল চড়া জানা সত্ত্বেও তাকে তিন কিলোমিটার দূর থেকে পায়ে হেঁটে বিদ্যালয়ে আসতে হতো। এখন তারা সবাই মিলে সাইকেলে আসতে পারছে, এর মজাই আলাদা।

নিয়ামতপুর উপজেলার চাঁচাইবাড়ি গ্রামের মো. ছইবর আলীর মেয়ে সুমাইয়া খাতুন এই বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূর থেকে সুমাইয়া বাইসাইকেলে চড়ে বিদ্যালয়ে আসে। মেয়ের বাইসাইকেলে চড়ে বিদ্যালয়ে আসার ব্যাপারে জানতে চাইলে ছইবর আলী বলেন, মেয়েটা কষ্ট করে এতটা পথ হেঁটে স্কুলে যেত। অনেক সময় লাগত। সময়মতো স্কুলে পৌঁছাতে পারত না। সাইকেল পেয়ে মেয়ের কষ্টটা দূর হয়েছে।

এই বিদ্যালয়ের উদ্যোক্তা শালবাড়ি গ্রামের মাসুদ রানা প্রথম আলো বন্ধুসভার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। তিনি বলেন, দূরের বিদ্যালয়ে যাতায়াত করা কঠিন, এ কারণেই অনেক মেয়ের লেখাপড়া হয়নি। অনেক মেধাবী মেয়ের বাল্যবিবাহ হয়েছে। এই চিন্তা থেকেই তিনি প্রথম আলো ট্রাস্টের এই বিদ্যালয়ে বাইসাইকেল দেওয়ার প্রস্তাব করেছিলেন। তিনি বলেন, এখন বাইসাইকেল দেওয়াতে আশা করা যায়, এলাকায় আর বাল্যবিবাহ হবে না। মেয়েরা শিক্ষাজীবন থেকে ঝরে পড়বে না।

সম্প্রতি ওই বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, সব সাইকেলগুলো বিদ্যালয় মাঠের এক পাশে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। বিদ্যালয় ছুটির পর দেখা গেল শিক্ষার্থীরা তাদের বইয়ের ব্যাগ পিঠে নিয়ে সারিবদ্ধভাবে যে যার সাইকেলে চেপে মাঠ পেরিয়ে চলে যাচ্ছে। গ্রামের বাঁকা পথ ধরে এই সাইকেলের সারি দূরে চলে যাওয়ার দৃশ্যটি ছিল অপূর্ব।