নারীরা শিক্ষিত হয়েও বেকার

অলংকরণ: আরাফাত করিম
অলংকরণ: আরাফাত করিম

আকলিমা আক্তার (ছদ্মনাম) নব্বইয়ের দশকে একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফাইন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিংয়ে স্নাতকোত্তর করেছেন। বিয়ের আগে আকলিমা চাকরি করেছেন। বিভিন্ন প্রকল্পে কাজ করার সময় রাত তিনটার সময়ও বাসায় ফিরেছেন। তবে বিয়ের পর সব ইস্তফা দিতে হয়, কারণ স্বামী তাঁর চাকরি করা পছন্দ করেন না।

আকলিমা বললেন, শুধু তিনি নন, তাঁর আরেক বোন অর্থনীতিতে এমএ পাস করে বর্তমানে সংসার সামলাচ্ছেন। আরেক চাচাতো বোন ইঞ্জিনিয়ার, কোথাও কাজ করেন না। তাঁর পরিচয় এখন শুধুই গৃহিণী।

আকলিমা বললেন, ‘এমএতে আমিসহ ছাত্রীসংখ্যা ছিলাম মাত্র ছয়জন। এর মধ্যে তিনজনই কর্মক্ষেত্র থেকে ছিটকে পড়েছে। এখন মাঝেমধ্যেই হতাশায় ভুগি। আমার যে বান্ধবীরা সংগ্রাম করে কর্মক্ষেত্রে টিকে আছে তারা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছে। আর আমি রান্না, মেয়েদের স্কুলে আনা-নেওয়াসহ একই ধাঁচের কাজ করে যাচ্ছি বছরের পর বছর। এখন প্রায়ই একঘেয়েমি লাগে।’

 শিক্ষিত হয়েও কর্মক্ষেত্রে নেই এমন আকলিমাদের সংখ্যা কত, তা নিয়ে সেভাবে গবেষণা নেই।

চলতি বছরে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার ‘এশিয়া প্যাসিফিক এমপ্লয়েমেন্ট অ্যান্ড সোস্যাল আউটলুক’ শীর্ষক গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশে নারীর বেকারত্বের হার পুরুষের চারগুণ। নারীদের বেকারত্বের হারে উচ্চশিক্ষিত নারীর সংখ্যাই বেশি।

২০১৬-১৭ সালের শ্রমজরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার মাত্র ৫৫ দশমিক ৮ শতাংশ শ্রমবাজারে রয়েছে। ২৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে শ্রমবাজারে আছেন মাত্র ৩৪ শতাংশ। আবার এই নারীদের বড় অংশই কৃষিতে কর্মরত। বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইজ) ২০১৬–১৭ অর্থবছরের পরিসংখ্যান বলছে, স্কুলশিক্ষা সমাপ্ত করেছেন তাদের প্রায় ৫৪ শতাংশ নারী। কলেজশিক্ষায় নারীর ভাগ ৪৭ দশমিক ২৪ শতাংশ। উপ–আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় প্রায় ২৩ শতাংশ এবং স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যন্ত শিক্ষিতদের প্রায় ৪২ শতাংশই ছিলেন নারী। অন্যদিকে আনুষ্ঠানিক কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ সবচেয়ে বেশি থাকার কথা ছিল সেই সেবা ও বিপণনকাজে নারীর অংশগ্রহণ ৫ শতাংশেরও কম (৪.৯৫%)। আর ব্যবস্থাপনা পর্যায়ে নারীর সংখ্যা মাত্র ০ দশমিক ৫৭ শতাংশ।

 শিক্ষা গ্রহণের পর নারীরা কেন কর্মবিমুখ হয়ে পড়েন, সে বিষয়েও তেমন কোনো জরিপ নেই। বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্ক (বিডিওএসএন) দীর্ঘদিন ধরে তথ্য ও প্রযুক্তি খাতে নারীদের অনুপস্থিতি নিয়ে কাজ করছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব আইসিটি ইন ডেভেলপমেন্টের পক্ষে বিডিওএসএনের ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোবটিক্স ও মেকাট্রনিক্স ডিপার্টমেন্টের প্রধান লাফিফা জামাল স্বল্পপরিসরে করা একটি জরিপে দেখেছেন, প্রকৌশলবিদ্যায় নারীদের শিক্ষার হার যত বাড়ছে কাজে অংশ নেওয়ার হার সেভাবে বাড়ছে না। তিনি বললেন, ২০১৫ সালে এই ইন্ডাস্ট্রিতে মাত্র ৯ শতাংশ নারী ছিলেন। বিডিওএসএন এবং সরকারের পক্ষ থেকে অনেক ধরনের প্রশিক্ষণ, বৃত্তি এবং আর্থিক সহায়তার পর ২০১৭ সালে এসে এর পরিমাণ দাঁড়ায় মাত্র ১১-১২ শতাংশ, কিন্তু প্রকৌশলশিক্ষায় নারী ছিল প্রায় ২৫ শতাংশ।

লাফিফা জামাল জানালেন, জরিপ বলছে, দীর্ঘ কর্মঘণ্টা, প্রতিমুহূর্তে নিজেকে উন্নত করা, বাড়ি থেকে দূরে গিয়ে কাজ করার মতো চ্যালেঞ্জগুলো নারীরা একটা সময় পর আর নিতে পারছিলেন না। ফলে কর্মজীবন থেকে ছিটকে যান।

২০০৬ থেকে ২০১৫ সালে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলে (বিএমডিসি) নিবন্ধিত ৩৪ হাজার ৬৯৭ জন চিকিৎসকের তথ্য বিশ্লেষণ করে ব্র্যাক জেমস পি গ্রান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ ও আইসিডিডিআরবির গবেষকেরা দেখেছেন, তাঁদের মধ্যে ৪৮ শতাংশ পুরুষ চিকিৎসক ও ৫২ শতাংশ নারী চিকিৎসক। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে অনলাইন মেডিকেল জার্নাল প্লজ ওয়ানে প্রকাশিত গবেষণায় এমবিবিএস শেষ বর্ষের সরকারি মেডিকেলের ২০৭ জন ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ১০৭ জন ছাত্রীর ওপর জরিপ করা হয়। জরিপে অংশ নেওয়া ছাত্রীদের ১৭ শতাংশ বলেছিলেন, বিয়ের বাজারে এই পেশার দাম আছে। এই গবেষণায় ছাত্রীরা বিয়ের পর পরিস্থিতি নাটকীয়ভাবে পাল্টে যাওয়া, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার সমস্যাসহ বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের কথাও তুলে ধরেন। এই গবেষণা প্রবন্ধেই উল্লেখ করা হয়েছে, এমবিবিএস পাস করলেও অনেক নারী চিকিৎসক পেশা চর্চার ক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয় হয়ে যান, অনেকে পেশা ছেড়ে দেন। প্রতিবেশী দেশ ভারতেও এই প্রবণতা আছে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবং গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী বললেন, অর্থনীতির মাপকাঠিতে মাপা হয় যে শ্রমবাজার সেখানে নারীর বিশেষ করে শিক্ষিত নারীর অংশগ্রহণ সেভাবে বাড়ছে না। নারীকে কর্মক্ষেত্রে ধরে রাখার জন্য আবাসন, শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র, কর্মক্ষেত্রের নিরাপদ পরিবেশ বা যানবাহনে নিরাপত্তা নিশ্চিতে সেভাবে বিনিয়োগ করা হচ্ছে না।

জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম গত বছর ১৬ অক্টোবর একটি যুব সম্মেলনের আয়োজন করে। এ সম্মেলনে ৩০ শতাংশ নারী অংশ নিয়েও কর্মক্ষেত্র থেকে ছিটকে যাওয়ার পেছনে দীর্ঘ কর্মঘণ্টা, পরিবার চাচ্ছে না মেয়ে কাজ করুক অর্থাৎ প্রায় একই ধরনের কারণ উল্লেখ করেন। এ সম্মেলনের কথা উল্লেখ করে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বললেন, অনেক প্রতিষ্ঠানই এখন পর্যন্ত নারী কর্মী নিয়োগ দিতে অনীহা প্রকাশ করে, যাকে একটি বড় চ্যালেঞ্জ বলা যায়।

 বাংলাদেশ গবেষণা উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের জ্যেষ্ঠ রিসার্চ ফেলো অর্থনীতিবিদ নাজনীন আহমেদ বলছেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্বামীর উপার্জন ভালো হলে নারীরা আর কর্মক্ষেত্রে আসার গরজ দেখান না। এ ছাড়া একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে একক পরিবার হওয়ায় ঘরের কাজের দায় পুরোটাই নারীর কাঁধে এসে পড়েছে, ঘর আর বাইরের কাজ সামলানো নারীর জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। নারী-পুরুষ মিলেমিশে ঘরের কাজ করলে নারীরা অনায়াসেই বাইরে কাজ করতে পারবেন।