দিন শেষে পাশে থাকবে পরিবার

মিন–লিয়াং ট্যান
মিন–লিয়াং ট্যান
>

সিঙ্গাপুরভিত্তিক গেমিং হার্ডওয়্যারের প্রতিষ্ঠান রেজার ইনকরপোরেটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও সহ-প্রতিষ্ঠাতা মিন-লিয়াং ট্যান। প্রযুক্তির দুনিয়ায় সেরা ১০ প্রভাবশালী ব্যক্তির একজন হিসেবে তাঁকে স্থান দিয়েছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান জুনিপার রিসার্চ। ২০১৭ সালে তিনি সিঙ্গাপুরে সর্বকনিষ্ঠ, স্বপ্রতিষ্ঠিত বিলিয়নিয়ার হিসেবে স্বীকৃতি পান। গত ৬ আগস্ট সিঙ্গাপুর ম্যানেজমেন্ট ইউনিভার্সিটির সমাবর্তনে বক্তা ছিলেন তিনি।

আজকের সমাবর্তনে শামিল হতে পেরে আমি আনন্দিত। বেশি দিন হয়নি, আমি ছিলাম তোমাদেরই একজন। সত্যি কথা বলতে, আমার সমাবর্তনে কে বক্তব্য দিয়েছিলেন, সে কথা এখন আর মনে নেই। তাই তোমরা যদি আমার একটি কথাও মনে না রাখো, আমি রাগ করব না।

আজ আমি তোমাদের তিন প্রকার মানুষের কথা বলব, যাঁদের সঙ্গে জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে তোমরা পরিচিত হবে।

প্রথমেই যাঁদের কথা বলব, তাঁদের সঙ্গে তোমাদের জীবনের শুরুতেই পরিচয় হয়ে গেছে। তাঁদের অনেকেই আজ এখানে উপস্থিত আছেন, অনেকে আসতে পারেননি। যাঁরা অনুপস্থিত, তাঁরাও আছেন তোমাদের ভাবনায়। এঁরা হলেন তোমাদের পরিবার-পরিজন। এঁদের জন্যই কিন্তু তোমরা আজ এত দূর আসতে পেরেছ। আমার জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হলেন আমার বাবা ও মা। আমার বাবা ছিলেন উচ্চশিক্ষিত, ব্যক্তিত্ববান লোক। তাঁর পরিবারে সচ্ছলতা ছিল না। সে কারণে অল্প বয়সেই রোজগারে নেমে পড়লেন। এতে লেখাপড়ায় ভাটা পড়ল। দেরিতে স্কুলে ভর্তি হলেন। তাতে কি তিনি দমে গেলেন? পড়াশোনা শেষে বৃত্তি জোগাড় করে নিলেন। পেলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ, সেই সঙ্গে ওখানেই খণ্ডকালীন চাকরির ব্যবস্থা।

অন্যদিকে আমার মায়ের পরিবারেও অসচ্ছলতা ছিল। তাঁর বাবার সামান্য চাকরি—কোনো এক বিদ্যালয়ের পাহারাদার। পরিবারসহ সে স্কুলের প্রাঙ্গণেই তাঁরা থাকেন। বাবার মতো মা কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাননি। অর্থাৎ নিজেদের জীবনে তাঁরা কোনোমতে খেয়ে-পরে বেঁচে ছিলেন। কিন্তু সন্তানের বেলায় কখনো কার্পণ্য করেননি। সব সময় আমাদের ভালোটাই চেয়েছেন। বিনিময়ে যা চাইতেন তা হলো, আমাদের মঙ্গল হোক; আমরা বড় হই। ভেবো না, স্কুলজীবনে আমি একজন আদর্শ ছাত্র ছিলাম। বরং এর ঠিক উল্টোটা! পড়ার চেয়ে ভিডিও গেম খেলায় ঝোঁক ছিল বেশি। অহরহ স্কুল ফাঁকি দিতাম। এমন সব বিষয়ে ভালো করতাম, যেগুলোর প্রতি আমার আগ্রহ ছিল। বাকিগুলোতে ডাব্বা! প্রায়ই শিক্ষকেরা বাবা-মাকে ডেকে পাঠাতেন। এখন বুঝি, গুরুজনের মনে কত-না কষ্ট দিয়েছি, বিশেষ করে মায়ের মনে। সে জন্য আজও আফসোস করি।

মা-বাবা আমাদের ভাইবোনদের কড়া শাসনে বড় করেছেন। তা সত্ত্বেও তাঁরা প্রায়ই বলতেন, তোমরা তোমাদের যা ইচ্ছে তা-ই হতে পারবে; কিন্তু স্নাতকের পর। এ ক্ষেত্রে তাঁদের যুক্তি ছিল, তাঁরা আমাদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ করে দিয়েছেন, যেন দুর্দিনে অন্তত খাদ্যের কষ্ট না হয়। জীবনে তাঁরা যে অভাব দেখেছেন, আমরা যেন তার মুখোমুখি না হই।

আমাকে অনেকে প্রায়ই একটি প্রশ্ন করেন। আমি আইনে ক্যারিয়ার মাঝপথে ছেড়ে দিয়ে স্টার্টআপ শুরু করি। তাঁদের প্রশ্ন, আমার বাবা-মা সেটাকে কীভাবে গ্রহণ করলেন? তাঁদের প্রতিক্রিয়া কী? সত্যি কথা বলতে, আমি যে ওকালতি ছেড়েছি, সে কথাটা কখনো তাঁদের আমি জানাইনি। সোজা আইন ছেড়ে একমাত্র সঞ্চয়—৪ হাজার ডলার দিয়ে খুলে বসলাম রেজার নামের এক প্রতিষ্ঠান। একসময় আমার মা-বাবা বুঝে গেলেন, আমি আইন ছেড়ে দিয়েছি। হয়তো আমার পোশাক-আশাকে হঠাৎ পরিবর্তন তাঁদের সে ধারণা দিয়েছিল। কারণ সে সময়ই আমি কালো শার্ট ও জিন্স পরতে আরম্ভ করেছি। তারা নিজে থেকেই বুঝে গিয়েছিলেন। আমার বলার প্রয়োজন হয়নি। কিন্তু কেন পেশা পরিবর্তন করেছি, সেই প্রশ্ন তাঁরা আমায় কখনো করেননি।

মিন–লিয়াং ট্যান
মিন–লিয়াং ট্যান

জীবনের এ পর্যায়ে এসে পরিবার নিয়ে আমার বেশ কিছু ধারণা জন্মেছে। পরিবার আসলে তোমাদের সেই কাজটি করার উপদেশ দিয়ে থাকে, যা তাঁদের মতে তোমাদের জন্য মঙ্গলজনক। এ কথাটি হয়তো অনেকের কাছেই শুনেছ। কিন্তু যা হয়তো কেউ তোমাদের বলেনি, তা হলো তুমি তাঁদের উপদেশ গ্রহণ করো কি বর্জন করো, দিন শেষে তোমার পরিবারই তোমার পাশে থাকবে। তা তুমি যে সিদ্ধান্তই না-ও না কেন।

এবার দ্বিতীয় দলটির কথা বলি। এদের সঙ্গে তোমাদের দেখা হবে কর্মক্ষেত্রে। তোমরা কাজ করতে গিয়ে তাদের সান্নিধ্য পাবে। তোমাদের মতো আমিও নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি। আমি উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেয়েছি। আইন নিয়ে কাজ করাটা ছিল আমার জন্য আনন্দের। কিন্তু অন্য একটি বিষয়ের প্রতি ছিল আমার প্রবল অনুরাগ, যার সঙ্গে বলতে গেলে স্কুল-কলেজের পড়াশোনার কোনো সম্পর্কই ছিল না। আর তা হচ্ছে গেমিং।

আজই তোমার দিন। ভাবো নতুন করে জন্ম নিয়েছ। সিদ্ধান্ত নাও, তুমি কোন কাজটি করতে ভালোবাসো। এমনও হতে পারে, জীবনভর যে কাজটি করে এসেছ, যা নিয়ে পড়াশোনা করেছ, তার প্রতি তোমার অনুরাগ নেই। ভাগ্য ভালো হলে, আমার মতো নিজের ভালো লাগার বিষয় খুঁজে পাবে। যদি না পাও, তো বর্তমানে যে কাজ করছ, তাতে মন দাও, কাজটাকে আপন করে নাও এবং সেই সঙ্গে পছন্দের কাজটাও খুঁজতে থাকো, যতক্ষণ না পর্যন্ত খুঁজে পাও।

২০০৫ সাল। ক্যারিয়ার নিয়ে নতুনভাবে ভাবতে শুরু করি। একটা গতি খুঁজে পাই। ১২ বছর পর আমার প্রতিষ্ঠান হংকং স্টক এক্সচেঞ্জে পাবলিক কোম্পানি হিসেবে নিবন্ধিত হয়। এখন আমার প্রতিষ্ঠান গেমারদের জন্য একটা ‘গ্লোবাল লাইফস্টাইল ব্র্যান্ড’-এ পরিণত হয়েছে। কিন্তু এতে আমার একার কৃতিত্ব নেই। হ্যাঁ, আমার ভূমিকা কমবেশি তো আছেই। কিন্তু সেই সঙ্গে কৃতিত্ব আমার দলেরও, যাঁরা এত দিন ধরে আমার সঙ্গে কাজ করে আসছেন।

এঁদের সঙ্গে আমার কর্মসূত্রে পরিচয়। তোমাদের জীবনেও যাঁদের সঙ্গে কর্মসূত্রে পরিচয় হবে, তাঁরাই মূলত নির্ধারণ করবেন, তুমি সফল নাকি ব্যর্থ হবে। বলে বোঝাতে পারব না, এই লোকগুলো তোমাদের জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে, নতুন চাকরির ক্ষেত্রে। শুধু কি বেতন ও পদবি? কর্মক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তুমি কাদের সঙ্গে কাজ করছ, কাদের জন্য কাজ করছ এবং কোন পরিবেশে কাজ করছ।

যদি তোমার সহকর্মী হন নেতিবাচক ও জটিল। যাঁরা দায়িত্বশীল নন, আন্তরিক নন, তবে তুমি ব্যর্থ হতে বাধ্য। অন্যদিকে ভাগ্য ভালো থাকলে জ্ঞানী ও কর্মোদ্যোগী সহকর্মীর সাহচর্য পাবে। এঁরা নিজেরা ভালো করতে চান, প্রতিষ্ঠান ও নিজেদের সহকর্মীদের নিয়েও ভাবেন। এঁদের সাহচর্য পেলে তুমি সফল হবেই। আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি, কারণ কাজ করতে গিয়ে আমি কিছু প্রখর বুদ্ধিসম্পন্ন ও কর্মোদ্যোগী লোকের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। পরে তাঁদের কেউ কেউ হয়েছেন আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু, সহকর্মী ও মেন্টর।

তৃতীয় ব্যক্তি তাঁরা, যাঁদের কাছে তোমরা ঋণী। বিশ্বের একটা নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে তোমরা স্নাতক করছ। তোমরা যে এত দূর আসতে পেরেছ, এতে অনেকের অবদান। অনেকেই তোমাদের সাহায্য করেছে। পাশে থেকেছে। তোমরা জানো কি না জানি না; তোমরা কিন্তু এঁদের কাছে ঋণী। এবার তোমার নৈতিক দায়িত্ব তাঁদের জন্য কিছু করা। প্রতিদান দেওয়া। এখন কাকে তুমি প্রতিদান দেবে, তা তোমায় খুঁজে বের করতে হবে। হতে পারে তোমার এলাকার জন্য কিছু করলে। হতে পারে তোমার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কিংবা গোটা সিঙ্গাপুরের জন্য কিছু করলে। আর যখনই কোনো কাজ করতে যাবে, নিজের প্রতি আস্থা রাখবে। যেন অন্য কারও কথা তোমার মন ভেঙে না দেয়। দৃঢ়প্রত্যয়ী হও। জীবনটা খুব অল্প সময়ের জন্য। এ সময় নেতিবাচক চিন্তাগুলো যেন তোমার ওপর ভর করে না বসে।

ইংরেজি থেকে অনুবাদ: শাহরোজা নাহরিন, সূত্র: ইউটিউব