ভাইয়ের পথে গতির রথে আইমান
২২ জুন। চেন্নাইয়ের মাদ্রাজ মোটর রেস ট্র্যাক।
মাথায় হেলমেট। গায়ে রেসিংয়ের পোশাক। হাত স্টিয়ারিংয়ে। মনে মনে হয়তো ট্র্যাকটার কোন কোণে কী করতে হবে, তা আরেকবার ঝালিয়ে নিচ্ছিল আইমান সাদাত। একটু দুশ্চিন্তাও কি হচ্ছিল তার? হয়তো। ট্র্যাকের বাইরে আরও দুটি মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ—আইমানের বাবা মিকাইল সাদাত ও মা লায়লা বেগমের।
দুশ্চিন্তার কারণ? বৃষ্টি হচ্ছিল বেশ। একটু আগেই অন্য রেসে একসঙ্গে নয়টি গাড়ি একটার সঙ্গে একটার ধাক্কা লেগেছিল। মিকাইল সাদাত বলছিলেন, ‘ওদের গাড়িগুলোতে তো ব্রেকের হিসাব থাকে। কোনো জায়গায় হয়তো ৫০ মিটার আগে ব্রেক চাপতে হয়, কোথাও ১০০ মিটার দূর থেকে। রেসের আগে ওদের প্রশিক্ষকও বারবার বলে দিচ্ছিলেন, আজ আগেভাগে ব্রেক কোরো। আগে যেটা ১০০ মিটারে করতে, আজ সেটা ১৩০ মিটারে করবে। বেশি জোরে ব্রেক করলেও গাড়ি ট্র্যাক থেকে বের হয়ে যাওয়ার শঙ্কা থাকে।’
ওই রেসের দুই মাসের বেশি সময় পর গত ২৯ আগস্ট ঢাকায় প্রথম আলো কার্যালয়ে কথা হচ্ছিল মা-বাবার সঙ্গে আসা আইমানের সঙ্গে। রেসের স্মৃতি ভাসছিল তার চোখে, ‘আমি কিচ্ছু দেখছিলাম না। শুধু সামনের গাড়ির ব্রেক লাইট অনুসরণ করছিলাম। একটা গাড়ির পেছনে ছিলাম বলে আমার তো আরও কষ্ট বেশি। ওর চাকার পানি এসে পড়ছিল আমার গাড়ির উইন্ডশিল্ডে (সামনের কাচ)।’
কিন্তু ভয়, শত সংশয়, রেস শেষে পরিণত হয়েছিল জয়ের উচ্ছ্বাসে। রেসে দ্বিতীয় হয়েছে আইমান। চট্টগ্রামের ১৬ বছর বয়সী ছেলের হাত ধরে ভিনদেশের পোডিয়ামে উঠল বাংলাদেশের পতাকা।
অবশ্য ভারতের এই রেসিং ট্র্যাকে বাংলাদেশি পতাকা ওঠা এবারই প্রথম নয়। আইমানেরই বড় ভাই আফনান সাদাত দুই বছর আগে এই পোডিয়ামে উঠেছিলেন। প্রথম আলোর ছুটির দিনেতে তখন তাঁকে নিয়েও ‘আফনানের লক্ষ্য এবার ফর্মুলা ওয়ান’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। ভাইয়ের দেখানো পথে এগিয়ে যাচ্ছে আইমানও।
সদ্য হাঁটতে শেখা শিশুর গুটি গুটি পদক্ষেপ যেমন, আইমানের পথচলা এখন পর্যন্ত তেমনি। চট্টগ্রামের ১৬ বছর বয়সী ছেলের বাসার রেসিং সিমুলেটরের (প্রশিক্ষণের জন্য ব্যবহৃত যন্ত্র) সামনের স্টিয়ারিং ছেড়ে এবারই প্রথম আসল রেস ট্র্যাকে নামা। কিন্তু সেই ছোটবেলা থেকে রেসিং যার ধ্যানজ্ঞান, সাফল্য পেতে সেই আইমানের সময় লাগল না। ভারতে ভক্সওয়াগন অ্যামিও কাপে প্রথমবার নেমেই এখন পর্যন্ত ১৮ জন রেসারের মধ্যে সম্মিলিত তালিকায় ষষ্ঠ আইমান, আর জুনিয়র শ্রেণিতে সবার শীর্ষে।
জুনিয়র শ্রেণি কী, সেটি পরিষ্কার করে বলছিল আইমান নিজেই, ‘জুনিয়র শ্রেণি বলতে আলাদা কোনো রেস কিন্তু নয়, একই রেসেই ১৮ জনের ফল থেকে সম্মিলিত তালিকা হয়। আর এর মধ্যে যাঁদের বয়স ২৫-এর নিচে কিন্তু জীবনে কখনো রেস করেননি, তাঁদের হিসাবটা নিয়ে হয় জুনিয়র তালিকা।’
টুর্নামেন্টে ১১টি রেসের মধ্যে ৮টি শেষ, চলতি মাসের ১৪-১৫ তারিখ হবে শেষ তিন রেস। সেখানে বর্তমান অবস্থান ধরে রাখতে পারলেই জুনিয়র শ্রেণিতে চ্যাম্পিয়ন হয়ে যাবে আইমান। ‘দুটি রেসে দ্বিতীয় হয়ে এ পর্যন্ত দুবার পোডিয়ামে উঠেছি, সেটি কিন্তু অত বড় ব্যাপার নয়। শিরোপাটা পেলে সেটি হবে অনেক অনেক বড় কিছু’—জ্বলজ্বলে হয়ে ওঠে আইমানের চোখ।
সে ভবিষ্যতের স্বপ্ন, লম্বা সাক্ষাৎকারে কথা হচ্ছিল দুই ভাইয়ের বেড়ে ওঠা নিয়ে। বাংলাদেশে যেখানে ছোট ছেলেমেয়েদের জন্য খেলায় বড় কিছুর স্বপ্ন মানেই ‘সাকিব আল হাসান’ হওয়া, সেখানে রেসিং কেন? একে তো বাংলাদেশে খেলাটা জনপ্রিয় নয়, প্রচলিতও নয়, কোনো ফেডারেশন বা সংগঠন থাকার তো প্রশ্নই আসে না। যা করার ব্যক্তিগত উদ্যোগেই করতে হয়।
দুই ভাইয়ের রেসিংয়ে আসার কথা বলতে গিয়ে তাদের বাবা মিকাইল সাদাত চলে গেলেন বড় ছেলে আফফানের সময়ের গল্পে। বর্তমানে কানাডায় উচ্চতর পড়ালেখার পাশাপাশি রেসিংচর্চা চালিয়ে যাওয়া আফফানের রেসিংয়ে ঝোঁক ছিল কম বয়স থেকেই। ঝোঁক হবে না-ই বা কেন? বর্তমানে ইস্পাত ব্যবসায়ী মিকাইল সাদাতের একসময়ে ছিল গাড়ি আমদানির ব্যবসা। ছেলের ঝোঁক বুঝতে পেরে এসএসসি পরীক্ষা শেষে তাঁকে ইংল্যান্ডে নিয়ে যান মিকাইল সাদাত। রেসিং ট্র্যাকে নিয়ে অনুশীলন করালেন। কিন্তু প্রতিদিনের অনুশীলনের খরচ প্রায় ৬০ হাজার টাকা। সেখানে বসেই ভারতের রেসিং ট্র্যাকের কথা জানতে পারেন মিকাইল সাদাত।
ছোট ছেলে আইমানের পথচলা অনেকটাই সহজ হয়ে গেল। বাসায় অনুশীলনের জন্য বড় ভাই আফনানের সিমুলেটর ছিল। সেটাতেও চলল চর্চা। আইমান তাই সোজা ভারতে গিয়ে রেসিং ট্র্যাকে নেমে পড়তে পারল। কখনো কোয়েম্বাটুর ট্র্যাকে, তো কখনো চেন্নাইয়ে। তার রেসিং লাইসেন্স ভারত থেকে নেওয়া। এরপর শুধু রেসিং ট্র্যাকে গতির ঝড় তোলা। আইমান হিসাব দিচ্ছিল, ‘কোয়েম্বাটুরে তুলেছিলাম প্রতি ঘণ্টায় ১৮৯ কিলোমিটার, চেন্নাইয়ে ১৮২, আর বৃষ্টির ওই দিনটিতে ১৫০-১৫৫ কিলোমিটার গতি।’
গতির ঝড়ের এই খেলায় তার অনুপ্রেরণা কিন্তু বিশ্বজুড়ে পরিচিত কোনো নাম নয়। ‘অনেকে বলে লুইস হ্যামিল্টন বা একে-ওকে অনুসরণ করি, আমার ওরকম কেউ নেই’—বলছিল আইমান। ‘আমার অনুপ্রেরণা আমার বড় ভাই।’ পরামর্শও এই সূত্র থেকে আসে। চেন্নাইয়ের রেসিং ট্র্যাকে ১২টি বাঁক আছে, তার মধ্যে চারটি বাঁকে একটু ঝামেলা হচ্ছিল আইমানের। সমাধান? কানাডা থেকে ভিডিও কলে কাগজে-কলমে এঁকে কোথায় কী করতে হবে দেখিয়ে দিয়েছিলেন বড় ভাই আফফান।
আইমানের স্বপ্নও বড় ভাইয়ের মতোই—একদিন ফর্মুলা ওয়ানে তুলবেন গতির ঝড়। আপাতত তার লাইসেন্স দিয়ে ফর্মুলা ফোর পর্যন্ত যাওয়া যাবে, এরপর ফর্মুলা থ্রি, সেখান থেকে ফর্মুলা ওয়ান। আইমান স্বপ্ন দেখে, একদিন বাংলাদেশে রেসিং ট্র্যাক হবে। শুধু তারা দুই ভাই নয়, আরও অনেকেই আসবে রেসিংয়ে।