মোটরদৌড়ে পদকজয়ী

হাতে স্টিয়ারিং হুইল, পায়ের নিচে ব্রেক। তীব্র গতিতে ছুটছে গাড়ি। এর চেয়ে রোমাঞ্চ আর কীই–বা হতে পারে। আর সেই রোমাঞ্চই ছোটবেলা থেকে পেয়ে এসেছেন তৌহিদ আনোয়ার। ফর্মুলা রেসের আন্তর্জাতিক জগতে অভিক আনোয়ার নামে পরিচিত বাংলাদেশের এই মোটর রেসার। গত আগস্টে মালয়েশিয়ার ফর্মুলা ওয়ান ট্র্যাক সেপাং আন্তর্জাতিক সার্কিটে জিতেছেন ব্রোঞ্জপদক। বাংলাদেশের প্রথম রেসার হিসেবে আন্তর্জাতিক পদক মঞ্চে উঠেছেন অভিক আনোয়ার। মালয়েশীয় চ্যাম্পিয়নশিপ সিরিজের চতুর্থ রাউন্ডের দ্বিতীয় রেসে ৪৮ দেশের প্রতিযোগীদের মধ্যে তৃতীয় হয়েছিলেন মুন্সিগঞ্জের এই যুবক।

স্বপ্নের শুরু যেভাবে

বাবা আনোয়ার হোসেনের গাড়ির ব্যবসা। ছোটবেলা থেকেই নানা ব্র্যান্ডের গাড়ি দেখে বড় হয়েছেন। প্রায়ই বাবার দোকানে গিয়ে গাড়ি ছুঁয়ে দেখতেন। তখনই শখ জাগে গাড়ি নিয়ে ভিন্ন কিছু করার। এরপর বাবাকে না জানিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে গাড়ি চালনা শেখেন। ওই সময় টিভিতে দেখতেন ফর্মুলা ওয়ান রেসিং। চোখের নিমেষে বিশ্বখ্যাত রেসার মাইকেল শুমাখার, মিকা হাকিনেনদের ছুটে চলা দেখতেন। তাঁদের দেখেই একদিন স্বপ্ন জাগে গাড়িতে গতির ঝড় তোলার।

ঢাকার গুলশানে অভিকের গাড়ির দোকান। ৪ সেপ্টেম্বর সেখানে বসে অভিক বলছিলেন, ‘আমি তখন নিয়মিত ফর্মুলা ওয়ান দেখতাম। মাইকেল শুমাখারের রেসিং দেখে একদিন মনে হলো, আহা, যদি আমিও এমন করে ছুটতে পারতাম। সেই থেকে শুরু।’

অভিক আনোয়ার। ছবি: সংগৃহীত
অভিক আনোয়ার। ছবি: সংগৃহীত

লড়াইটা নিজের সঙ্গে

বাংলাদেশে মোটরদৌড়ের কোনো জায়গা মানে রেসিং ট্র্যাক নেই। নেই কার রেসিংয়ের প্রশিক্ষকসহ অন্য সুযোগ-সুবিধাও। কিন্তু তাই বলে থেমে থাকেননি অভিক আনোয়ার। প্লে স্টেশনের গেম আর সিমুলেটর ছিল ভরসা। প্লে স্টেশনে খেলতেন গ্রান ট্যুরিসমো স্পোর্ট। বন্ধুরা প্রায়ই হাসাহাসি করতেন আর বলতেন, ‘এসব অবাস্তব গেম খেলে কী হবে?’ বন্ধুদের বোঝাতেই পারতেন না যে এই খেলার সঙ্গে বাস্তবে গাড়ি চালানোর কতটা মিল রয়েছে। শেষ পর্যন্ত ২০০৭ সালে কানাডায় উচ্চতর পড়াশোনার জন্য গেলে সেখানেই মেলে অনুশীলনের সুযোগ।

পিৎজার দোকান থেকে রেসিং ট্র্যাকে

কার রেসিং একটি ব্যয়বহুল খেলা। অনুশীলন করতেও প্রয়োজন মোটা অঙ্কের অর্থ। সেই টাকা হয়তো অভিক তাঁর বাবার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা নেননি। কানাডায় পড়াশোনার ফাঁকে কাজ করতেন পিৎজা সরবরাহের। কখনো রেস্তোরাঁর সবজি কেটেছেন, কখনো লাইব্রেরিতে করেছেন খণ্ডকালীন চাকরি। এসব কাজ করে জমানো টাকা দিয়ে গাড়ি কেনেন। কানাডার অনুশীলন ট্র্যাকে গিয়ে নিয়মিত চর্চা করতেন। অনুশীলন করতে করতেই কার রেসিংয়ে নিজের সম্ভাবনাও আঁচ করেন অভিক। এরপর ২০১২ সালে পড়াশোনা শেষে ফিরে আসেন ঢাকায়।

গাড়ি হাঁকিয়ে ছুটছেন অভিক
গাড়ি হাঁকিয়ে ছুটছেন অভিক

চ্যাম্পিয়নের নেশা

বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত হওয়া একমাত্র মোটর স্পোর্টস প্রতিযোগিতা র‌্যালি ক্রসে ২০১৪ সাল থেকে অংশ নেন অভিক। ঢাকায় হওয়া সেই প্রতিযোগিতায় হয়েছেন হ্যাটট্রিক চ্যাম্পিয়ন। কিন্তু শেষবার পেছনের গাড়ি থেকে এগিয়ে ছিলেন সময়ের ব্যবধানে অনেকটাই। সেই আত্মবিশ্বাস আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রেস করার সাহস জোগায় অভিকের, ‘প্রথম দুবার মাইক্রো সেকেন্ডের ব্যবধানে প্রথম হই। কিন্তু ২০১৬ সালে যখন চ্যাম্পিয়ন হলাম, দেখি সময়ের হিসাবে আমার চেয়ে অনেক পেছনে পড়ে আছেন দ্বিতীয় রেসার। তখনই ভারতে খেলতে যাওয়ার চিন্তা করি।’

এরপর ভারতের ভক্সওয়াগন কাপে ২০১৭ সালে অংশ নিয়েই চতুর্থ হন অভিক; যা তাঁর আত্মবিশ্বাসের পালে লাগায় নতুন হাওয়া, ‘ভক্সওয়াগন অ্যামিও কাপে চতুর্থ হওয়ার পর নতুন করে অনুপ্রেরণা পাই। এরপর মাদ্রাজ মোটর রেস ট্র্যাকে খেলেছি। খুবই কঠিন ছিল ওখানে খেলা। তবে এ বছরের শুরু থেকে মনে হলো পুরোপুরি রেসে মনোযোগ দেব। রেস একটা জিততেই হবে আমাকে।’

মালয়েশীয় চ্যাম্পিয়নশিপ সিরিজের একটি পর্বে তৃতীয় সেরার পুরস্কার হাতে অভিক আনোয়ার (ডানে)। ছবি: সংগৃহীত
মালয়েশীয় চ্যাম্পিয়নশিপ সিরিজের একটি পর্বে তৃতীয় সেরার পুরস্কার হাতে অভিক আনোয়ার (ডানে)। ছবি: সংগৃহীত

ব্যবসা সামলে খেলা

দেশে অনুশীলনের সুযোগ নেই। তাই প্রায়ই বিদেশে চলে যান অনুশীলনের জন্য। রেসের অনুশীলনের জন্য ব্যবসাপাতি থেকেও মনোযোগ উঠিয়ে নেন। অনুশীলনের এক সপ্তাহে মুঠোফোন, ফেসবুকসহ সব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান ইচ্ছা করে। তখন শুধু হোটেল থেকে রেস ট্র্যাকে যান, অনুশীলন শেষে ফিরে আসেন হোটেলে। অনুশীলনের সময় রেস ট্র্যাক থেকে কিছু উপাত্ত (ডেটা) ল্যাপটপে দিয়ে দেওয়া হয়। সেখান থেকে ল্যাপটপে বসে নিজের খেলার দুর্বলতা দেখেন। কোথায় উন্নতি করতে হবে, সেগুলো বোঝার চেষ্টা করেন।

ব্যবসা সামলে একাগ্র অনুশীলনে অংশ নেওয়ার কাজটি যে খুবই কঠিন কাজ, তা অভিকের ভাষায় স্পষ্ট, ‘আমার কার রেসিংয়ের প্রতি খুব আগ্রহ রয়েছে বলেই খেলতে পারছি। কিন্তু ব্যবসার পাশাপাশি এটা করা খুব কঠিন। কারণ, প্রতিদিন হাজার হাজার গাড়ির ব্যাপারে কথা বলতে হয়। ব্যাংকিং, এলসি (লেটার অব ক্রেডিট), পারচেজ দেখতে হয়।’

তবু স্বপ্ন দেখা

দেশে একেবারে অপ্রচলিত খেলা ফর্মুলা রেসিং। কিন্তু এই খেলাতেও সম্ভাবনা দেখেন অভিক, ‘এটা সত্যি যে আমাদের দেশে কোনো অবকাঠামো নেই। এই দেশে দারিদ্র্যের হার বেশি। মানুষ হয়তো চিন্তা করবে, যেখানে অনেকে খেতে পাচ্ছে না, সেখানে রেস করছে। এটা নেতিবাচক দিক। কিন্তু ইতিবাচক দিক হলো যদি সত্যিই খেলার সুযোগ থাকে, তাহলে অনেক যুবক নেশায় জড়াবে না। কারণ, আমি জানি, গাড়ির প্রতি তরুণদের অনেক মায়া। গাড়ির প্রতি তখন টাকা খরচ করবে। ড্রাগসের দিকে ঝুঁকবে না। রেস করলে রাস্তায় জোরে চালানোর প্রবণতাও কমবে। চিন্তা করবে, জোরে গাড়ি চালিয়ে তো কিছু পাচ্ছি না। কিন্তু রেসে গাড়ি চালিয়ে পুরস্কার তো পাব। তখন জোরে গাড়ি চালানো বন্ধ করে দেবে এমনিতেই।’

বিশ্বের বুকে বাংলার পতাকা

মালয়েশিয়ায় পদক জেতার পর যেন ঘোরলাগা জগতে ছিলেন অভিক, ‘আমার তো শুরুতে বিশ্বাসই হচ্ছিল না। অনেক পরে বিশ্বাস হলো, আমি পেরেছি। নিজেকে নিজেই বললাম, দুই বছর পর অবশেষে স্বপ্ন সত্যি হলো।’ অভিকের হাতে শুরু বাংলাদেশের ফর্মুলা ওয়ান ট্র্যাকের পথচলা। কে জানে হয়তো একদিন ফর্মুলা ওয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে উড়বে লাল-সবুজের পতাকা। জীবনটাই তো গতির, এখানে থেমে থাকার কিছু নেই। অভিক যেন সেই গতিরই প্রতীক, থেমে থাকতে চান না। ছুটতে চান আরও সামনে।