'একা' মায়ের সংগ্রাম

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

সৈয়দা জিনিয়া মোমেন। ২০১২ সালে বিয়ের চার মাসের মাথায় বুঝতে পারেন স্বামী নেশা করেন। আস্তে আস্তে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের মাত্রা বাড়তে থাকে। এমনকি সন্তান পেটে আসার পরও রেহাই মেলেনি। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় একদিন রাতে বাড়ি ফিরে পিস্তল উঁচিয়ে ধরে তাঁকে মেরে ফেলতে চান। এভাবে চলতে চলতে মেয়ের বয়স যখন ১০ মাস, তখন সিদ্ধান্ত নেন এভাবে আর নয়।

 জিনিয়া মোমেন বললেন,‘ ২০১৪ সালে বাবাই আমাকে স্বামীর বাড়ি থেকে নিয়ে আসেন। পরে স্বামী তালাকনামা পাঠিয়ে দিলে আমি আর আপত্তি করিনি। তবে সন্তান কেন সবকিছু থেকে বঞ্চিত হবে? তাই মেয়ের ভরণপোষণ ও আমার দেনমোহরের দাবিতে মামলা করি ২০১৬ সালে। মামলা চলছে। ৬ বছর বয়সী মেয়েকে নিয়ে কাজে বের হই। সারা দিন পর ঘরে ফিরি। আমরা মা ও মেয়ে ভালো আছি।’

জিনিয়া জানালেন, তাঁর বাবা পাশে ছিলেন বলে দ্রুত স্বামীর বাড়ি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলেন। পরে বাবা মারা গেলেও বাবার বাড়ির আশ্রয়টা এখনো আছে। এখন আর শারীরিক বা মানসিক নির্যাতনের ভয় তাড়া করে না। 

জিনিয়া মোমেনের পরিচয় এখন সিঙ্গেল মাদার বা ‘একা মা’। এই পরিচয়েই জিনিয়া মোমেন প্রথম আলোর কার্যালয়ে বসে কথা বললেন। তবে সামাজিক চাপ ও সন্তানের কথা চিন্তা করে অনেক নারী এখনো একা মা হিসেবে পরিচয় দিতে সংকোচ বোধ করেন।

আলফা আরজু ও তাঁর সন্তানেরা
আলফা আরজু ও তাঁর সন্তানেরা

সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের বিভিন্ন পরিসংখ্যান বলছে, সমাজে জিনিয়া মোমেনদের মতো নারীদের সংখ্যা বাড়ছে। প্রথম আলোয় গত বছর প্রকাশিত ‘ঢাকায় ঘণ্টায় এক তালাক’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ছয় বছরে ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে অর্ধলাখের বেশি তালাকের আবেদন জমা পড়েছে। এ হিসাবে মাসে গড়ে ৭৩৬টি, দিনে ২৪টির বেশি এবং ঘণ্টায় একটি তালাকের আবেদন করা হচ্ছে।

গত বছরের জুনে প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘দ্য সিচুয়েশন অব ভাইটাল স্ট্যাটেসটিকস’-এর তথ্য বলছে, গত সাত বছরে তালাকের প্রবণতা ৩৪ শতাংশ বেড়েছে। শিক্ষিত স্বামী-স্ত্রীদের মধ্যে তালাক বেশি হচ্ছে।

সরকারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী গ্রামীণ হতদরিদ্র পরিবারে তালাকপ্রাপ্ত, স্বামী পরিত্যক্তা ও বিধবা নারীর সংখ্যাও বাড়ছে। ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছর থেকে সরকারের সমাজসেবা অধিদপ্তর ‘বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলা ভাতা’ শিরোনামে একটি কর্মসূচি পরিচালনা করছে। শুরুতে এ ধরনের ৪ লাখ ৩ হাজার ১১০ জন নারীকে মাসিক ১০০ টাকা হারে ভাতা দেওয়া হয়। আর ২০১৯-২০ অর্থ বছরে ভাতাভোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ। দরিদ্র পরিবারে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তালাকের পর অথবা স্বামী মারা গেলে ওই নারী তাঁর নিজের পরিবার থেকেও তেমন একটা সহায়তা পান না।

কম বয়সেই বিয়ে হয়ে সিলেটের নাহার বানুর। কয়েক বছরের মাথায় স্বামী আরেক বিয়ে করলে দুই সন্তান নিয়ে বাবার বাড়ি ফিরে আসেন তিনি। নাহার বানুর বাবাও একই ভাবে তাঁর মা এবং অন্য ভাইবোনদের ফেলে চলে গিয়েছিলেন। আর্থিক অসংগতির কারণে সন্তানদের মায়ের কাছে রেখে নাহার বানু ঢাকায় এসে গৃহকর্মীর কাজ নেন। মুঠোফোনে নাহার বানু জানালেন, ঢাকায় এভাবে কয়েক বছর কাজ করে সন্তানদের আর একটু ভালোভাবে রাখার জন্য তিনি পাড়ি জমিয়েছেন সৌদি আরব। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামিনা লুৎফা বললেন, ঘরে ও বাইরে বিভিন্ন দায়িত্ব সামলানোর পর একা মায়েদের সন্তান লালনপালনও করতে হচ্ছে। এই মায়েদের বোঝা কমানোর জন্য পরিবার ও সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে।

সৈয়দা জিনিয়া মোমেন তাঁর মেয়ের সঙ্গে
সৈয়দা জিনিয়া মোমেন তাঁর মেয়ের সঙ্গে

 একা মায়েদের নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে সন্তানকে খাপ খাওয়াতেও অনেক সময় দিতে হয়। বাংলাদেশে সাংবাদিকতা করতেন এবং বর্তমানে দুই সন্তান নিয়ে অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী একা মা আলফা আরজু বললেন, ‘একা মায়ের সন্তানেরা অনেক বেশি সহনশীল ও বুঝদার হয়। তবে, এটা প্রথম দিন থেকেই হয় না। সময় নিয়ে সন্তানদের আস্তে আস্তে বোঝাতে হয়। আমার সন্তানদের সঙ্গে আর্থিক ও পারিবারিক সব বিষয়ে খোলামেলা কথা বলেছি বা এখনো বলছি। তবে শুরুতে অন্য বন্ধু বা শিশুদের মতো মা-বাবাসহ পারিবারিক পরিবেশ নেই বলে ওরা খুব নিরাপত্তাহীনতায় ভুগত। তাই পেশাগত কাউন্সিলর দিয়ে দীর্ঘদিন তাদের কাউন্সেলিং করানো হয়েছে। এখন আমার ছেলে-মেয়ে জানে, মা-বাবার মধ্যে বিচ্ছেদ হতেই পারে, কিন্তু মা-বাবা দুজনই ওদের ভালোবাসেন ও স্নেহ করেন।’

বিধবা বা বিবাহবিচ্ছেদ হওয়া নারীকে এখন পর্যন্ত সমাজের অনেকেই সহজভাবে নিতে পারে না। বাড়ি ভাড়া বা সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করার সময় ওই নারীকে বারবার বিরুপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। 

একা মায়েরা বলছেন, তাঁদের সংগ্রামকে খানিকটা সহজ করতে কিছু ভাতা দেওয়া ছাড়া রাষ্ট্রের পক্ষ থেকেও তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রের সুবিধা কর্মজীবী একা মায়েদের অত্যন্ত জরুরি প্রয়োজনের নাম। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় রাজধানীতেই এ ধরনের কেন্দ্রের সংখ্যা হাতে গোনা। 

তিন বছর আগে স্বামী মারা যাওয়া কানিজ ফাতেমা জানালেন, স্বামী মারা যাওয়ার পর শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রের অভাবে চাকরি ছাড়তে বাধ্য হন। কানিজ ফাতেমার মা-বাবা মারা গেছেন। স্বামী মারা যাওয়ার পর শ্বশুরবাড়ি ছাড়তে হয় দুই সন্তানকে নিয়ে। চাকরি করে ৯ বছর বয়সী মেয়ে আর সাড়ে চার বছর বয়সী ছেলেকে নিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছিল। অথচ অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নটাও জরুরি। তাই বর্তমানে ঘরে বসেই কোনো ব্যবসা করার কথা ভাবছেন বলে জানালেন।