নারীর অগ্রগতিতে বিশ্বের স্বীকৃতি

অলংকরণ: আরাফাত করিম
অলংকরণ: আরাফাত করিম

কৃষক বাবার মৃত্যুর পর মেয়ে মর্জিনা বেগম নেমে পড়েন কৃষিকাজে। নারী কৃষকদের নিয়ে গড়ে তোলেন সিএআরডি নামের একটি সংগঠন। নারীদের স্বাবলম্বী করতে নানা প্রশিক্ষণ, কেঁচো সার তৈরি, নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে কাজ করতে থাকেন। এভাবে অল্পদিনে গোটা গ্রামের বেশ কিছু নারীকে স্বাবলম্বী করে তুললেন তিনি।

ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার মহেশ্বরচাঁদা গ্রামের কৃষক ওমর আলীর মেয়ে মর্জিনা বেগম।

 ২০১৪ সালে এককভাবে ও ২০১৭ সালে মর্জিনার সংগঠন সিএআরডি বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার পেয়েছে। নিজ গ্রাম মহেশ্বরচাঁদায় শুধু না, মর্জিনার কাজের পরিধি বিস্তৃত হয়েছে পাশের সাত গ্রামে।

দরিদ্র থেকে উন্নয়নশীল, এরপর মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে উত্তরণের পথে বাংলাদেশ। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বাংলাদেশের উত্তরণের পেছনে অনেকটাই নারীর অবদান।

 বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যেই এগোতে হচ্ছে নারীদের। সব ক্ষেত্রে অর্জন আকাশছোঁয়া নয়। তারপরও শুধু দক্ষিণ এশিয়া নয়, মাতৃ ও শিশুমৃত্যু কমানোসহ সামাজিক নানা সূচকে নারীদের অগ্রগতিতে নানা বৈশ্বিক স্বীকৃতি মিলেছে।

সামাজিক সূচকে নারীদের এই অগ্রগতিকে বড় অর্জন বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান। তিনি বললেন, ‘সরকারি-বেসরকারি নানা তৎপরতা আছে বটে তবে বাংলাদেশের নারীদের নিজস্ব উন্নয়ন স্পৃহা এই অগ্রগতির প্রধান চালিকাশক্তি।’

গত বছর ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) সর্বশেষ বৈশ্বিক লিঙ্গবৈষম্য প্রতিবেদনে নারী-পুরুষের সমতার দিক দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় সব দেশের ওপরে স্থান পায় বাংলাদেশ।

 পাবনার চাটমোহর উপজেলার বিল কুড়ালিয়ায় ভূমিহীনদের জমি উদ্ধারে রশিদা খাতুন, আছিয়া বেগম ও আভা রানীদের অবদান আছে। পৌনে ৫০০ একর জমি তাঁরা আদায় করে নেন ১৯৯৩ সালে। জমি উদ্ধারের পর এখানকার ১ হাজার ৪০০ পরিবারের শিক্ষার প্রসার, বাল্যবিবাহ রোধসহ নানা উদ্যোগে শামিল হয়েছেন বিল কুড়ালিয়ার নারীরা।

কুড়ালিয়ার স্থানীয় ভূমিহীনদের এই আন্দোলনে সহযোগিতা করে বেসরকারি সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি)। সংগঠনটির কর্মসূচি সমন্বয়কারী সানজিদা খান বললেন, ‘জোতদারদের হয়ে পুলিশ যখন আন্দোলনকারীদের ধরতে আসত, তখন মানববর্ম তৈরি করে রুখে দিতেন এ গ্রামের নারীরা।’

খ্যাতনামা ভারতীয় অর্থনীতিবিদ জঁ দ্রেজ তাঁর ঝোলাওয়ালা অর্থনীতি ও কাণ্ডজ্ঞান বইয়ে বাংলাদেশ-বন্দনায় বলেছেন, ‘সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারতের থেকে এগিয়ে গেছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষায় লিঙ্গবৈষম্য দূর করতে সক্ষম হয়েছে। লিঙ্গবৈষম্যের অন্যান্য সূচকে বাংলাদেশের অবস্থা ভারতের চেয়ে ভালো।এমনকি কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণও বাংলাদেশের বেশি।’

লন্ডন স্কুল অব ইকনোমিকসের সাবেক এই শিক্ষক জঁ দ্রেজ ভারতের তুলনায় যেসব সূচকে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার উদাহরণ দিয়েছেন তার বেশির ভাগই নারীকেন্দ্রিক বা নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণের ফলেই তা অর্জন করা সম্ভব হয়েছে।

নারীর কর্মসংস্থানের বিষয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় এগিয়ে থাকা দেশগুলোর অন্যতম বাংলাদেশ। গত এক দশকে পুরুষ ও নারীর মধ্যে মজুরিবৈষম্যও কমিয়ে এনেছে উল্লেখযোগ্য হারে। বিশ্বব্যাংকের ‘ভয়েসেস টু চয়েসেস: বাংলাদেশেস জার্নি ইন উইমেনস ইকোনমিক এমপাওয়ারমেন্ট’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ যদি এ ধারা অব্যাহত রাখতে পারে তবে লিঙ্গসমতা আরও বাড়বে।

 চাকরি, অর্থায়ন ও সম্পদের মালিকানার ক্ষেত্রে নারীদের পছন্দ, নিয়ন্ত্রণ ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা এখনো কম। তবে ২০০৩ সাল থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে শ্রমবাজারে বাংলাদেশের নারীর অংশগ্রহণের হার ২৬ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৩৬ শতাংশ।

জেন্ডার বিশেষজ্ঞ ফেরদৌসি সুলতানা বলছেন, নারীর অর্জনকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখার সুযোগ নেই। নারীর অগ্রগতিতেই সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে, কর্মসংস্থান ও পুষ্টিমান বেড়েছে। শিক্ষার প্রসার এখানে একটা বড় ভূমিকা রেখেছে। আর এর ফলে বেড়েছে সচেতনতা।

নারী শিক্ষা বিস্তার ও নারী উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে বাংলাদেশ বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে একটি সম্মানজনক অবস্থানে পৌঁছেছে। ২০১১ সালে বাংলাদেশে নারী শিক্ষার হার ছিল ৪৬ দশমিক ৭ শতাংশ, যা ২০১৭ সালে ৭০ দশমিক ১ শতাংশে দাঁড়ায়। গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৬ সালে বাংলাদেশে পুরুষের তুলনায় নারীর অগ্রগতি ছিল ৬২ শতাংশের বেশি যা গত বছর দাঁড়ায় ৭১ শতাংশ।

নারীর অগ্রগতির সঙ্গে দেশে দিন দিন বেড়েছে নারীর উন্নয়নে বাজেট বরাদ্দ। ২০০৯-১০ অর্থবছরে নারী উন্নয়নে বাজেটে ২৭ হাজার ১৪৮ কোটি রাখা হয়। এটি ছিল মোট বাজেটের ২৪ দশমিক ৬৫ ভাগ। আর মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৩ দশমিক ৯৫ শতাংশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে নারী উন্নয়নে বরাদ্দ আছে ১ লাখ ৬১ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা। এটি মোট বাজেটের ৩১ শতাংশ প্রায়। আর জিডিপির ৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ।

নারীদের নানা অগ্রগতি থাকলেও অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান মনে করেন, কর্মক্ষেত্রে নারীর অপেক্ষাকৃত কম অংশগ্রহণ এবং নারীর প্রতি সহিংসতা বিভিন্ন অর্জনকে ম্লান করে দিচ্ছে বা বাধাগ্রস্ত করছে। সুশাসনের অভাব এর বড় একটা কারণ। সরকারকে এই দিকটায় নজর দিতে হবে। কেননা সার্বিক সুশাসন শুধু নারীর অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করবে না, উন্নয়নের জন্যও এটি অপরিহার্য।