খাদিজা-তরিকুলের প্রথাভাঙা বিয়ে

>বিয়ে করতে বরের বাড়ি হাজির হয়েছিলেন কনে। বরযাত্রার বদলে সে যাত্রার নাম ছিল কনেযাত্রা। প্রথাভাঙা এই ঘটনা এরই মধ্যে হয়তো অনেকের জানা। এবার নিজেদের বিয়ের কথা লিখেছেন কনে খাদিজা আক্তার ও বর তরিকুল ইসলাম।
কনের বাড়ির অনুষ্ঠানের নাম ছিল বরভাত
কনের বাড়ির অনুষ্ঠানের নাম ছিল বরভাত

আমার বাবা কামরুজ্জামান একজন কৃষক। তিনিই আমার আদর্শ। বেড়ে ওঠার দিনগুলোতে দেখেছি, তাঁর অবসরের সঙ্গী বই আর সংবাদপত্র। মায়ের হাতে পড়াশোনায় হাতেখড়ি হলেও বাবার কাছে পেয়েছি পাঠ্যবইয়ের বাইরের বই পড়ার উৎসাহ। তাঁর মুখেই প্রথম শুনি বেগম রোকেয়া ও কবি সুফিয়া কামালের নাম, নারী জাগরণে তাঁদের অবদানের কাহিনি, যা আমার কিশোরী মনে নাড়া দিয়েছিল; নারী নয়, মানুষ হিসেবে পথ চলার সাহস জুগিয়েছিল। তারই প্রতিফলন হয়তো আমার এই বিয়ের ব্যতিক্রমী আয়োজন।

এ আয়োজনের কথা বলতে হলে পাঁচ মাস পেছনে ফিরে যেতে হবে। সোনিয়া নামের আমার এক বন্ধুর পাশের গ্রামে বিয়ে হয়। সেই বিয়ে শেষে বর যখন তাকে নিয়ে যাচ্ছিল, তখনই বন্ধুদের অনেকটা কৌতুক করে বলেছিলাম—পুরুষ যদি নারীকে বিয়ে করে বাড়ি নিয়ে যেতে পারে, তাহলে নারী কেন পারবে না?

সেটা যে বাস্তব হবে, তা কিন্তু ভাবিনি। আমার বিয়ে যখন পাকাপাকি হয়ে এল, সে সময় বাবার সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বললাম। প্রথা ভাঙা তো সহজ কথা নয়, তবে তিনি রাজি হলেন বিষয়টি নিয়ে বরপক্ষের সঙ্গে কথা বলতে।

বিয়ের সাজে বর তরিকুল ইসলাম ও কনে খাদিজা আক্তার। ছবি: সংগৃহীত
বিয়ের সাজে বর তরিকুল ইসলাম ও কনে খাদিজা আক্তার। ছবি: সংগৃহীত

আমার শ্বশুর মেহেরপুর জেলা ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মাবুদ। তাঁদের বাড়ি গাংনী উপজেলায়। প্রগতিশীল মানুষটি মত দিতে সময় নেননি। অনেকটা এমন যেন তিনিও আমার মতোই ভাবছিলেন। কাকতালীয়ভাবে পরিকল্পনা মিলে যায়। দিন ঘনিয়ে আসছিল আর আমার মধ্যে চাপা উত্তেজনা ভর করছিল। যা কখনো হয়নি, যা দেখে মানুষ অভ্যস্ত নয়, তাই আয়োজন নিয়ে খুব চিন্তা হচ্ছিল।

২১ সেপ্টেম্বর, শনিবার। এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। সকাল থেকেই কনেযাত্রীদের যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল। বান্ধবীরা আমাকে সাজিয়ে-গুছিয়ে নেয়। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে শুরু হয় যাত্রা। নাম তার—কনেযাত্রা! মেয়ে হয়ে বিয়ে করতে যাচ্ছি, এ অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করে বোঝাতে পারব না। গাড়িবহরের প্রথমেই ফুল দিয়ে সাজানো গাড়িতে আমি। সঙ্গে কয়েকজন বান্ধবী। পেছনের ছয়টি মাইক্রোবাস ও মোটরসাইকেলে সব কনেযাত্রী। পথচলতি কেউ হয়তো বুঝতেই পারেনি। তাই চলতি পথে ভিড়ের মধ্যে কোথাও গাড়ি থামলে কৌতূহলী মানুষের চোখ শুধু কনে দেখে ছানাবড়া হয়ে যেত।

বেলা একটায় চৌগাছায় পৌঁছাই। আমার শ্বশুরবাড়ি থেকে প্রায় ১০০ গজ পর্যন্ত রাস্তার দুই ধারে বরপক্ষের লোকজন আমাকে বরণ করতে ফুলের ডালি নিয়ে অপেক্ষা করছে। সঙ্গে হাজারো কৌতূহলী মানুষ। কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে গাড়ি থেকে নামি। আমার গলায় একের পর এক ফুলের মালা পরিয়ে বরণ করে নেওয়া হয়। হেঁটে বিয়ের আসরের ফটক পর্যন্ত যাই। বরপক্ষের সঙ্গে কনেপক্ষের সওয়াল-জবাব চলে। কনেপক্ষ জিতে যাওয়ায় আমাকে মিষ্টিমুখ করানো হয়। এরপর গেটের ফিতা কেটে বিয়েবাড়িতে ঢুকি।

গেটের ফিতা কাটার পর আমার ননদ আর তার বন্ধুরা আমার হাত ধরে ভিড় ঠেলে বাড়ির ভেতরে নিয়ে যায়। চেয়ারে নিয়ে বসায়। সিংহাসনের মতো দুটি চেয়ারের একটিতে আমি, অন্যটিতে তরিকুল। আমরা পাশাপাশি বসি। নতুন বউ নিয়ে চিরাচরিত কৌতূহল তো বরের বাড়িতে থাকবেই। সেই কৌতূহলেই আমাকে দেখতে এসেছে অনেকে।

তরিকুল ইসলাম ও খাদিজা আক্তার। ছবি: সংগৃহীত
তরিকুল ইসলাম ও খাদিজা আক্তার। ছবি: সংগৃহীত

জীবনে অনেক বিয়েতে উপস্থিত হয়েছি। কখনো বরযাত্রী, কখনো কনের বাড়িতে গিয়ে বিয়ে দেখেছি। কিন্তু আমন্ত্রিত অতিথির বাইরেও এত মানুষের ভিড় কখনো এভাবে চোখে পড়েনি। লোকজন আমাকে যতই সাহসী বলুক না কেন, মানুষের ভিড় দেখে সেদিন বুকের ভেতরে যেন ড্রাম বাজছিল। তরিকুল আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মনের ভাষাটা বুঝতে পারে। কানের কাছে মুখ নিয়ে জানতে চায়, ‘কোনো সমস্যা?’ আমি ফিসফিসিয়ে বলি, টেনশন হচ্ছে! তরিকুল সাহস দিয়ে বলে, ‘ভয় নেই, আমি তো পাশেই আছি।’ আমাদের দুজনের কথোপকথনে ননদ ও তার বান্ধবীরা সজোরে হেসে ওঠে। তা দেখে উপস্থিত লোকজন কেউ বুঝে, কেউ না বুঝে সজোরে হেসে ওঠে। বাড়িজুড়ে ওঠে হাসির জোয়ার। আমি তো লজ্জায় লাল! 

বিয়ের মঞ্চে বসেই আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়। রেজিস্টারে সই করার পর একজন মাওলানা আমাদের দাম্পত্য জীবনের সুখ-শান্তি, ভবিষ্যৎ সন্তানসন্ততির মঙ্গল কামনা করে দোয়া করেন। আমার ঘনিষ্ঠ বান্ধবীরাও বসে আমার সঙ্গে।

খাওয়াদাওয়া শেষ হলে ননদ এসে আমাকে সঙ্গে করে পুরো বাড়ি ঘুরিয়ে দেখাতে চায়। কিন্তু মঞ্চ থেকে নেমে দেখি আমার স্যান্ডেল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এ সময় চাচাতো-মামাতো দেবর-ননদ ও ননদের বান্ধবীরা জানায়, স্যান্ডেল পেতে হলে বকশিশ দিতে হবে। তরিকুল সমস্যার সমাধান করতে চাইলেও আমি নিজের ওয়ালেট থেকে তাদের হাতে বকশিশ দিতেই স্যান্ডেল হাজির। এভাবে নানামুখী আনন্দে সময় হয় চুয়াডাঙ্গায় ফেরার। গাড়ির দিকে রওনা হতেই বুকের বাঁ পাশে চিনচিন করে ওঠে। হয়তো সেটা শ্বশুর-শাশুড়িসহ স্বামীর বাড়ি এবং সে বাড়ির মানুষদের জন্য।

আমাদের বাড়িতেই ২২ সেপ্টেম্বর বউভাতের আদলে ‘বরভাতের’ আয়োজন করা হয়। ব্যতিক্রম এই বিয়েকে বেশির ভাগ মানুষই সাহসী উদ্যোগ বলেছেন। বন্ধুরা তো দারুণ উপভোগ করেছে। সবকিছু মিলে এ এক অন্য রকম অনুভূতি।