কলসিন্দুরের অনন্য কীর্তির কারিগর

মফিজ উদ্দিন
মফিজ উদ্দিন

ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম কলসিন্দুর, এখন সারা দেশের মানুষের কাছে যে গ্রাম পরিচিত মেয়েদের ফুটবলের জন্য। কলসিন্দুরের স্কুলপড়ুয়া কিশোরীরা বাংলাদেশ জাতীয় দল থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন বয়সভিত্তিক দলে নিয়মিত ফুটবল খেলছে। কিশোরী ফুটবলারদের অনন্য এই কীর্তি গ্রামটিকে নানাভাবে রাঙিয়ে দিয়েছে। এসব অনন্য কীর্তির সূচনা হয়েছিল কলসিন্দুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৎকালীন সহকারী শিক্ষক মফিজ উদ্দিনের হাত দিয়ে।

প্রত্যন্ত গ্রামে ছিল হাজারো সমালোচনা। সেসব হজম করে মেয়েদের ফুটবলার হিসেবে গড়ে তোলার অসম্ভব এক প্রশিক্ষণ শুরু করেছিলেন মফিজ উদ্দিন। তাঁর হাত ধরেই ফুটবল মাঠে নামা মেয়েরা আজ জাতীয় পর্যায়ে দাপটের সঙ্গে মাঠ কাঁপাচ্ছে। ১৯৯৯ সালে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন মফিজ উদ্দিন। ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে পদোন্নতি পেয়ে বর্তমানে একই উপজেলার রণসিংহপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছেন।

মফিজ উদ্দিনের বাড়ি কলসিন্দুর থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরের গৌরীপুর গ্রামে। শৈশব কেটেছে গারো পাহাড়ে ওঠার স্বপ্ন দেখে আর খেলাধুলা করে। নিজের খেলোয়াড় হওয়ার স্বপ্ন পূরণ না হলেও ছাত্রীদের টানা তিনবার বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা গোল্ডকাপ টুর্নামেন্টে জাতীয় পর্যায়ের চ্যাম্পিয়ন করেছেন তিনি।

স্বপ্নের শুরুটা হয় ২০১০ সালে। তখন তিনি কলসিন্দুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। সেবার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছেলেদের বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ ফুটবলের ফাইনাল খেলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দেন, পরেরবার (২০১১ সাল) থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মেয়েদের ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হবে। ঘোষণার পর মফিজ উদ্দিন স্বপ্ন দেখেন কলসিন্দুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মেয়েদের নিয়ে একটি দল গড়বেন।

২০১১ সালে তিনি কলসিন্দুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মেয়েদের নিয়ে ফুটবল দল গড়লেন। শৈশবে নিজে ফুটবল খেলেছেন। সেই অভিজ্ঞতায় কোচের দায়িত্ব নিলেন তিনি। বিদ্যালয় ছুটির পর তিনি কলসিন্দুর মাঠে মেয়েদের জন্য ফুটবল প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলেন। ২০১১ সালে নিজের গড়া দল নিয়ে বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা গোল্ডকাপে অংশ নিয়ে জেলা পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হলেও জাতীয় পর্যায়ে হেরে যায় তাঁর দল। ২০১২ সালেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। কিন্তু হতাশ হলেন না মফিজ উদ্দিন। ২০১৩ সালে আবারও বঙ্গমাতায় অংশ নেওয়ার জন্য দল গড়লেন। অধরা স্বপ্নটা ধরা দেয় মফিজ উদ্দিনের হাতে। সেবার কলসিন্দুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা গোল্ডকাপে জাতীয় পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হয়ে যায়। এরপর থেকে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে মফিজ উদ্দিনের কলসিন্দুর। ২০১৪ ও ২০১৫ সালে টানা আরও দুবার বঙ্গমাতা ফুটবলের জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হয় কলসিন্দুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।

মফিজ উদ্দিন বলেন, ‘স্বপ্ন সত্যি করা কঠিন কাজ। আমার মেয়েরা সে কাজটি করেছিল। আমি কেবল ওদের পথ দেখিয়েছি। বিনিময়ে ওদের এবং আরও অনেক মানুষের যে ভালোবাসা পেয়েছি, তা অমূল্য। শিক্ষক জীবনে এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কী হতে পারে!’