যাঁর শ্রেষ্ঠত্বের গল্প দেশ ছাড়িয়ে বিদেশে

মো. নূরুল আলম
মো. নূরুল আলম

শিবরাম আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবস্থান গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলায়। তিন কক্ষের বিদ্যালয়টি ছিল জরাজীর্ণ। ১২৫ জন শিক্ষার্থীকে পাঠদান করতেন তিনজন শিক্ষক। ঠিক সে সময় প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন মো. নূরুল আলম। তাঁর ছোঁয়ায় বদলে যায় স্কুলটির পরিবেশ। আজ এই স্কুলের নাম ছড়িয়ে পড়েছে দেশ–বিদেশে। জাতীয় পুরস্কার অর্জন করেছে দেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যালয় হিসেবে। চীন, ফ্রান্স, পাকিস্তান, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড, জাপানসহ বিভিন্ন দেশের অসংখ্য প্রতিনিধি বিদ্যালয়টি পরিদর্শন করেন।

মো. নূরুল আলম প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন ১৯৮৪ সালে। তখনই শ্রেণিকক্ষের দেয়ালে এঁকে দেন ভূগোলের বিষয়–আশয়। দেয়ালে শোভা পায় দেশ-বিদেশের বরেণ্য কবি–সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী ও রাষ্ট্রনেতাদের ছবি। গানে গানে, পাতায় পাতায়, দীপের আলো, ঊর্মিমালা, নয়নের নীড়, মমতার মিলনের মতো নামকরণ করেন প্রতিটি শ্রেণিকক্ষের। শিক্ষার্থীরা তো বটেই, আশপাশের সবাই তাতে বিস্মিত। নূরুল আলম শিক্ষার্থীদের কেবল বিস্মিতই করেননি, বিস্ময়ের পেছনের গল্প শুনিয়েছেন। গল্প শুনে শিশুরা আগ্রহী হয়েছে অজানাকে জানার জন্য। এ কারণে নূরুল আলম জাতীয় পর্যায়ে ১৯৮৫ সালে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে সম্মাননা অর্জন করেন।

নূরুল আলম বলেন, ‘এরপর বিদ্যালয়ের পরিবেশ সুষ্ঠুভাবে নিয়ন্ত্রণ করা ও সাফল্যের ধারা আরও এগিয়ে নেওয়ার জন্য বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির পাশাপাশি শিক্ষক-অভিভাবক সমিতি, উপদেষ্টা পরিষদ, ছাত্রাবাস ব্যবস্থাপনা পরিষদ ও কল্যাণ সমিতিও গঠন করি।’ সেই সাফল্যের সূত্রে ১৯৯১ সালে ইউনিসেফ বিদ্যালয়টিকে শ্রেষ্ঠ বিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ১৯৯৬ সালে বিদ্যালয়টি অর্জন করে জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠত্ব। ২০০৬ সালে শতভাগ ছাত্রছাত্রীর উপস্থিতির জন্য দেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যালয় হিসেবে জাতীয় পুরস্কার লাভ করে শিবরাম আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।

তিন কক্ষের বিদ্যালয়ের জায়গায় এখন সরকারি উদ্যোগে দুটি দোতলা, একটি পাঁচতলা, স্থানীয় উদ্যোগে ২১টি আধা পাকা কক্ষ তৈরি করা হয়েছে। আরও অনেক আধুনিক সুযোগ–সুবিধার সঙ্গে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিনোদনের জন্য আছে পার্ক। এ ছাড়া নূরুল আলমের প্রচেষ্টায় এই বিদ্যালয় থেকে শিক্ষার্থীরা জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে পুরস্কৃত হয়েছে বারবার। তাঁর সাফল্যের কারণে বিদ্যালয়ে সরকার অনুমোদিত ১২ জন শিক্ষকের সঙ্গে ১০ জন শিক্ষক ও ২৩ জন কর্মচারী বেসরকারিভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়। বর্তমানে বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮৫০–এ।

নূরুল আলমের হাতে গড়া স্কুলটির আদলে দেশে প্রায় ২ হাজার ৫০০টি প্রাথমিক বিদ্যালয় গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে গাইবান্ধা জেলায় ৬০টি ও সারা দেশে ২ হাজার ৪৪০টি। নূরুল আলম বলেন, ‘আমি চাই, সারা দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো শিবরামের অনুকরণ করুক। এতে দেশে প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়ন ঘটবে। প্রয়োজনে শিক্ষকদের এখানে এনে হাতে–কলমে পাঠদানপদ্ধতির প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করতে হবে।’

৬৮ বছর বয়সী নূরুল আলম ২৭ বছর এই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। ২০১১ সালের ৪ সেপ্টেম্বর অবসর গ্রহণ করেন। কাজপাগল মানুষ তিনি। অবসর নিয়েও বসে থাকেননি। ২০১৩ সালে গাইবান্ধা জেলা শহরের ধানঘরা এলাকায় আমার বাংলা মাধ্যমিক বিদ্যাপীঠ নামে নতুন একটি বেসরকারি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন। এটিও বেশ সুনাম কুড়িয়েছে।