হাজারো শিক্ষার্থীর মা

নাছিমা আক্তার
নাছিমা আক্তার

বয়স তখন তিন কি চার। বড় বোনের সঙ্গে স্কুলে বেড়াতে গেছে ছোট্ট মেয়েটি। বোন ক্লাসে ব্যস্ত থাকায় স্কুলের মাঠে দৌড়ঝাঁপ করছিল সে। স্কুলের এক শিক্ষক এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার নাম কী?’ শিশুটি নাম বলল। শিক্ষক আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার পুরো নাম কী?’ শিশুটি নিজের পুরো নাম জানে না। পুরো নাম বাবার ডায়েরিতে লেখা আছে। কিন্তু এ কথা তো স্যারকে বলা যাবে না। কাজেই বুদ্ধি করে বলে ফেলল, ‘আমার পুরো নাম নাছিমা।’

কিছুক্ষণ পর বিষয়টি জানাজানি হলো। কেউ কেউ জানতে চাইল, কেন সে নিজের নাম বানিয়ে বানিয়ে নাছিমা বলল। শিশুটির সরল উত্তর, ‘বড় বোনের বইয়ের পড়ায় আছে, “নাছিমা ইজ আ গুড গার্ল, শি গোজ টু স্কুল রেগুলারলি”, তাই এই নাম বলেছি।’

সেই ঘটনার আরও দুই বছর পর শিশুটি যখন স্কুলে ভর্তি হলো, তখন স্কুলের খাতায় তার নাম হলো নাছিমা আক্তার। সেই নাছিমা আক্তার এখন ময়মনসিংহের ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাময়ী সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। লোকে বলে, শিক্ষকের আবরণে ঢাকা তিনি একজন মা। নাছিমা আক্তারকে আমরা জিজ্ঞেস করি, আপনার কতজন সন্তান? তিনি বলেন, ‘সংখ্যাটা সঠিক মনে নেই। শিক্ষার্থীরা আমাকে কতটুকু মা ভাবে, সেটা আমি বলতে পারব না। তবে দীর্ঘ শিক্ষকজীবনে সব শিক্ষার্থীকেই আমি সন্তান ভেবেছি।’

নাছিমা আক্তারের জন্ম জামালপুর জেলা সদরে। স্থানীয় বানিয়া বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও সিংহজানি উচ্চবিদ্যালয়ে স্কুল শেষ করেন। পরে জামালপুরের সরকারি জাহেদা সফির মহিলা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতকে উত্তীর্ণ। উচ্চমাধ্যমিক পেরোনোর পর ইচ্ছা ছিল ঢাকায় পড়ার। কিন্তু পরিবারের অর্থসংকটের কারণে তা হয়নি। স্নাতক শেষ করার পর ১৯৯০ সালে তিনি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তরে ভর্তি হন। জীবনের সেই অংশের গল্প আরও দাগ কাটার মতো। শুক্রবার ভোর চারটায় জামালপুর থেকে যে ট্রেন ঢাকার উদ্দেশে যেত, সুযোগ পেলে সেই ট্রেনে চেপে বসতেন। এরপর কমলাপুর স্টেশনে নেমে রিকশায় করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আবার ঢাকা থেকে সন্ধ্যার ট্রেন ধরে জামালপুর ফিরতে ফিরতে অনেক রাত। পরদিন আবারও স্কুলের শিক্ষকতা। এভাবে স্নাতকোত্তরও শেষ করেন নাছিমা।

১৯৯৭ সালে তিনি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে চাকরি পান। প্রথম কর্মস্থল ছিল জামালপুর সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। ২০১৫ সালে বিদ্যাময়ী সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন।

নাছিমা আক্তার বলেন, ‘আমি স্কুলের সব শিক্ষার্থীকে নিজের সন্তান মনে করি। বিনিময়ে শত শত শিক্ষার্থী আমাকে মা ডাকে। এটাই তো সবচেয়ে বড় পাওয়া।’