শুভ্রতার প্রতীক তারাপদ স্যার

প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সম্মানিত করতে আইপিডিসি-প্রথম আলোর উদ্যোগ ‘প্রিয় শিক্ষক সম্মাননা’। দেশজুড়ে কয়েক ধাপে অনুষ্ঠান শেষে ৪ অক্টোবর ঢাকায় হলো চূড়ান্ত পর্ব। এ অনুষ্ঠানে দেশের অনন্যসাধারণ ১২ জন শিক্ষককে সম্মানিত করেছে আইপিডিসি ও প্রথম আলো। যাঁদের মধ্যে ফরিদপুর উচ্চবিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক জগদীশ চন্দ্র ঘোষকে দেওয়া হয়েছে আজীবন সম্মাননা।
জগদীশ চন্দ্র ঘোষ
জগদীশ চন্দ্র ঘোষ
তাঁর কেতাবি নাম জগদীশ চন্দ্র ঘোষ। ফরিদপুর শহরের সবাই তাঁকে চেনেন তারাপদ স্যার নামে। কখনো চিন্তা করেননি শিক্ষক হবেন। তবে তারুণ্যের শুরুতে পেশা হিসেবে শিক্ষকতাই বেছে নিতে হয়েছিল। শুরু থেকে শিক্ষার্থীদের কাছে পরম প্রিয় তারাপদ স্যার। কেবল শিক্ষাবিস্তারে নয়, সমাজের যেকোনো উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সব সময় এগিয়ে এসেছেন এই শিক্ষাগুরু। ফরিদপুর উচ্চবিদ্যালয় থেকে অবসর নিয়েছেন ১৯৯৫ সালে। অবসরজীবনে শুভ্রতার প্রতীক হয়ে আছেন শিক্ষার্থীদের কাছে। তাঁকে নিয়ে লিখেছেন প্রবীর কান্তি বালা

দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই পরিচয় জানতে চাইলেন। পরিচয় পেয়ে বিছানা থেকে উঠে বসলেন। বললেন, ‘বয়স হয়েছে তো, হুট করে দেখে অনেককেই চিনতে কষ্ট হয়।’

লম্বা একহারা গড়ন। বয়স ৯১, চামড়া কুঁচকে গেছে। তাঁকে দেখে বোঝার উপায় নেই, কৈশোর আর তারুণ্যের দিনগুলোতে তিনিই ঘণ্টার পর ঘণ্টা নদীতে সাঁতার কাটতেন, কুস্তি লড়তেন দাপটের সঙ্গে। আরও পরে নানা সামাজিক আর সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে জড়িয়ে পড়েন আন্দোলন–সংগ্রামে। শিক্ষকতার জন্য হয়ে ওঠেন সবার শ্রদ্ধার পাত্র।

৬ অক্টোবর আমরা যাই ফরিদপুরের ঝিলটুলী মহল্লায় জগদীশ চন্দ্র ঘোষের বাড়িতে। আড্ডাপ্রিয় তারাপদ স্যার প্রিয় কাউকে পেলে আনন্দে উদ্বেল হয়ে ওঠেন। গল্পে ডুবে যান। একবার শুরু করলে অনর্গল কথা বলতে থাকেন। যার কিছু বোঝা যায়, বেশির ভাগই অস্পষ্ট। এক প্রসঙ্গ বলতে বলতে চলে যান অন্য প্রসঙ্গে। তাই সূত্র ধরিয়ে দিতে হয়। সেদিনও আমাদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে নিজের জীবনের গল্পে ডুব দিলেন তিনি।

মা–বাবার দ্বিতীয় সন্তান জগদীশ চন্দ্র ঘোষ। জন্ম মানিকগঞ্জের কাঞ্চনপুর গ্রামে, ১৯২৯ সালের ৬ আগস্ট। শিক্ষাজীবন শুরু ফরিদপুরের ঈশান গোপালপুর গ্রামের এক টোলে। সেখানে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে ভর্তি হন একই গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।

গ্রামে পড়াশোনা শেষ হলে জগদীশকে তাঁর বাবা নিয়ে যান ফরিদপুর শহরে। ভর্তি করিয়ে দেন হিতৈষী স্কুলে। স্কুলের পড়াশোনার চেয়ে অবশ্য কুমার নদের পাড়ে ঘুড়ি ওড়াতেই ভালো লাগত তাঁর। ভালোবাসতেন সাঁতার কাটতে। সারা দিন ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে কেটে যায় দুটি বছর।

ষষ্ঠ শ্রেণির চৌকাঠ পেরোতেই জগদীশকে আবার বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। ভর্তি হন শিবরামপুরের আর ডি একাডেমিতে। ১৯৪৮ সালে সেখান থেকেই ম্যাট্রিক পরীক্ষায় অংশ নেন। এরপর ভর্তি হন কলকাতায়, আশুতোষ কলেজে। কিছুদিন যেতেই কলকাতাজুড়ে শুরু হয় দাঙ্গা। প্রতিদিন খুন–হামলা। সেখান থেকে তাঁর এক আত্মীয়ের সঙ্গে বহরমপুর চলে যান। ভর্তি হন স্থানীয় একটি কলেজে। সেই প্রতিষ্ঠানেই ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে বিশেষ দক্ষ হয়ে ওঠেন তারাপদ। তবে ওই কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার আগেই তাঁকে ফিরে আসতে হয় বাড়িতে, ঈশান গোপালপুরে।

বাড়ি ফিরে চাকরি নেন পোস্টমাস্টারের। পোস্ট অফিসে চাকরি করতে গিয়েই খেয়াল করলেন, তাঁর বয়সী অনেকেই পড়ার জন্য প্রতিদিন আট মাইল দূরের ফরিদপুর শহরে যান। জগদীশ চন্দ্র তাঁদের ডেকে বলেন, ‘তোরা আমার কাছে পড়তে পারিস, আমি অঙ্ক ও ইংরেজি পড়াতে পারি।’

ম্যাট্রিক উত্তীর্ণ এক তরুণ উচ্চমাধ্যমিকের গণিত-ইংরেজি পড়াবে, এ কথা ভেবে কারও কারও চোখেমুখে ফুটে ওঠে অবিশ্বাসের ছাপ। অভয় দিয়ে তখন জগদীশ চন্দ্র বলেন, ‘একবার পড়েই দেখ, যদি পারি তবে পড়বি, না হলে পড়বি না।’

কয়েকজন তরুণ অবশ্য তারাপদ স্যারের ওপর আস্থা রাখেন। পড়া শুরু করার কয়েক দিনের মধ্যেই তরুণদের কাছে তারাপদ স্যার হয়ে ওঠেন নির্ভরতার প্রতীক। আর এভাবেই শিক্ষকতায় হাতেখড়ি জগদীশ চন্দ্র ঘোষের। ছাত্র পড়ানোর শুরুর কয়েক মাস পরেই পাশের গ্রামের এক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগ দেন প্রধান শিক্ষক হিসেবে। একই সঙ্গে স্থানীয় পোস্ট অফিসে পোস্টমাস্টারের চাকরিটিও চালিয়ে যান। সব মিলিয়ে মাস শেষে পান ২৬ টাকা।

কিন্তু ফরিদপুরের জন্য ভীষণ মন টানত জগদীশের। তাই ১৯৫৩ সালের দিকে ফিরে যান ফরিদপুরে। চাকরি পেয়ে যান শৈশবের সেই হিতৈষী স্কুলে। মাসে বেতন ৫০ টাকা। ফরিদপুরে তখন ভালো গণিত শিক্ষকের অভাব। তাই এক বছর যেতে না–যেতেই ময়েজউদ্দিন স্কুলে ডেকে নেওয়া হয় তাঁকে। ১৯৫৩ সালের শেষ দিকের কথা সেটি।

জগদীশ তখনো ম্যাট্রিক পাস। তাই তাঁর মনে হলো, অন্তত ডিগ্রি পাস করা উচিত। ১৯৫৪ সালে উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হন রাজেন্দ্র কলেজে। তত দিনে পারিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা ভেঙে পড়েছে। সব দায়িত্ব ওঠে তাঁর কাঁধে। দিনরাত টিউশনি করে কলেজের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। ফলে কলেজে যাওয়া বন্ধ, পড়াশোনায় বিরতি। চলতে থাকে শিক্ষকতা আর টিউশনি। ১৯৫৯ সালে যোগ দেন ফরিদপুর উচ্চবিদ্যালয়ে। পরের বছর প্রাইভেট ছাত্র হিসেবে উত্তীর্ণ হন উচ্চমাধ্যমিকে। এরপর বিএ পাসও করেন প্রাইভেট ছাত্র হিসেবে।

জগদীশ চন্দ্র ঘোষ ১৯৬৮ সালে যোগ দেন পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকায়। শিক্ষকতার শুরু থেকেই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন পরোক্ষভাবে। সমাজের নানা উন্নয়নকাজেও তাঁর অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। ফরিদপুরের জনপ্রিয় এই শিক্ষক সব সময় সাদা রঙের পোশাক পরেন। তাঁর ভাষায়, ‘আমি চাই, আমার সামনে যে ছাত্রটি বসে আছে, সে যেন আমার এই শুভ্রতা ধারণ করে। সে যেন এই স্নিগ্ধ রংকে তার মনন গঠনের রং হিসেবে বেছে নেয়। তার রুচি যেন হয় মানবতার রুচি।’

ছোটবেলা থেকেই রাজনীতি–সচেতন ছিলেন। কাছ থেকে দেখেছেন তাঁর চাচার স্বদেশি আন্দোলনে যুক্ততা। কিন্তু কখনো কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত হননি। ১৯৭১ সালের ২ মে পাকিস্তানি বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের শিকার হয় তাঁর পরিবার। ফরিদপুর সদরের ঈশান গোপালপুরে জমিদারবাড়ির হত্যাযঞ্জে ২৮ জন শহীদ হন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন জগদীশের বাবা যোগেশ চন্দ্র ঘোষ, ভাই গৌর গোপাল ঘোষ ও চাচাতো ভাই বাবলু ঘোষ।

এখনো যেকোনো শুভ কাজে তিনিই এগিয়ে আসেন সবার আগে। ফরিদপুর শহরে নারীশিক্ষার জন্য প্রথমে সারদা সুন্দরী মহিলা কলেজ এবং সারদা সুন্দরী বালিকা উচ্চবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় তাঁর ভূমিকা অগ্রগণ্য। এখনো ফরিদপুর টাউন থিয়েটার, ফরিদপুর প্রেসক্লাবসহ শহরের বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত আছেন তিনি। কখনো নেতা হননি। গুরুত্বপূর্ণ কোনো পদে যাননি। তবে নেতা নির্বাচনের কারিগর ছিলেন তিনি।

তাই তো শিক্ষকতা পেশার অনন্য উদাহরণ হয়ে উঠেছেন জগদীশ চন্দ্র ঘোষ। মানুষ তাঁকে দেখে গুরুভক্তি করে তাঁর কর্মের জন্যই। তিনি বলেন, ‘আজও আমি আমার অগুনতি ছাত্রছাত্রীর কাছ থেকে ভালোবাসা পাই। দূরদূরান্ত থেকে আজও যখন আমার ছাত্রছাত্রীরা আমাকে দেখতে আসে, আমাকে প্রণাম করে, আমি তাদের ভালোবাসায় আপ্লুত হই। নিজেকে সার্থক শিক্ষক বলে মনে হয়। এই ভালোবাসাই আমাকে সুস্থভাবে বাঁচিয়ে রাখে। এভাবেই আমি বেঁচে থাকতে চাই।’