সাহসের সঙ্গে স্বপ্ন দেখো: অ্যালিসন ফিলিক্স

অ্যালিসন ফিলিক্স
অ্যালিসন ফিলিক্স

মা হওয়ার কারণে ১৩ মাস ট্র্যাকের বাইরে ছিলেন অ্যালিসন ফিলিক্স। ৩৩ বছর বয়সী এই স্প্রিন্টার ট্র্যাকে ফেরেন গত জুলাইয়ে। সেপ্টেম্বরের ২৯ তারিখ দোহায় বিশ্ব অ্যাথলেটিকস চ্যাম্পিয়নশিপে নারী-পুরুষ মিশ্র ৪০০ মিটার রিলে দৌড়ে সেই ফিলিক্স জিতলেন স্বর্ণপদক। বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ ও অলিম্পিক মিলিয়ে ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে সবচেয়ে বেশি স্বর্ণ জয়ের রেকর্ড এখন তাঁর দখলে। যুক্তরাষ্ট্রের এই ট্র্যাকের রানি মোট পদকসংখ্যা বিচারে পেছনে ফেলেছেন জ্যামাইকার সাবেক গতিমানব উসাইন বোল্টকে। সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ফিলিক্সের পদক সংখ্যা ২৭। এর মধ্যে বিশ্বের একমাত্র ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড নারী অ্যাথলেট হিসেবে অলিম্পিকে পেয়েছেন ছয়টি স্বর্ণ, অলিম্পিকে তাঁর মোট পদক নয়টি। কেবল ট্র্যাকে নয়, পড়াশোনাতেও ভালো করেছেন ফিলিক্স। পড়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার রোসিয়ের স্কুল অব এডুকেশনে। ২০১৭ সালে নিজের বিদ্যায়তনে এই বক্তৃতা দিয়েছিলেন তিনি।

কী সৌভাগ্য, আজ এখানে তোমাদের সামনে দাঁড়াতে পেরেছি! শুরু করছি তোমাদের অভিনন্দন জানিয়ে। তোমরা পেরেছ, সম্পন্ন করেছ তোমাদের প্রশিক্ষণ। আমি ক্রীড়াবিদ। তাই আশা করছি, খেলাধুলা সম্পর্কিত কিছু রূপক কথাবার্তা তোমরা ঠিকই বুঝে নেবে।
তোমরা প্রশিক্ষণ নিয়েছ জীবনের দৌড়ে প্রস্তুত হওয়ার জন্য। জীবনের দৌড় শেষ করার জন্য এই শিক্ষা তোমাকে প্রয়োজনীয় কিছু হাতিয়ার দিয়েছে। কেবল দৌড় শেষ করতে নয়, তোমরা শিক্ষা পেয়েছ সমাজে প্রভাব বিস্তারের জন্য। এই শিক্ষা তোমাদের আত্মবিশ্বাস জোগাবে, প্রত্যয়ী করে তুলবে। পথে নামলে সব সামলে নিতে পারবে সহজেই। এখানে সদ্যই চমৎকার এবং কঠিন কিছু প্রশিক্ষণ নিয়েছ। ফলে তোমরা প্রস্তুত। তোমরা সুশিক্ষিত।
তোমাদের এই প্রশিক্ষণ সম্ভবত আরও আগে থেকেই শুরু হয়েছে।

আমিও তো এর মধ্য দিয়ে গেছি। আমার মা-বাবা দুজনই শিক্ষক। একেবারে ছেলেবেলাতেই আমাকে পড়াশোনার গুরুত্ব বুঝিয়েছিলেন তাঁরা। তবে মা-বাবা একটা সত্যিকারের উপহার আমাকে আমার অজান্তেই দিয়েছিলেন। শিক্ষার্থীদের ওপর তাঁদের দারুণ প্রভাব। তাঁদের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে দেখা হলে আমি বেজায় গর্ব বোধ করি। খুব ভালো লাগে যখন শিক্ষার্থীরা বলে, ‘তোমার মা-বাবা আমাদের প্রিয় শিক্ষক।’ যে কাজ তোমরা করতে যাচ্ছ তার গুরুত্ব আমি খুব ভালোভাবে অনুধাবন করছি। এটা পারছি আমার মা-বাবাকে দেখেছি বলে, তাঁদের কর্মজীবন দেখেছি বলে। তোমরা সবাই বদলের কারিগর। কারণ, তোমরা প্রস্তুত। তোমরা সুশিক্ষিত।

এই ক্যাম্পাসে আমি এসেছিলাম স্নাতক হতে। সেই সময়গুলো জীবনেও ভুলব না। এই ক্যাম্পাসের থার্টি সেকেন্ড স্ট্রিট ধরে হাঁটার সময় নবীন ছাত্রছাত্রীদের চোখের দিকে তাকাতাম। সে সময় আমি ওদের কৌতূহলী চোখগুলোতে রোমাঞ্চ দেখেছি। আমি জানি, যতটা না দিয়েছি তার চেয়ে ঢের বেশি পেয়েছি এখান থেকে। জীবনদর্শন ঠিক করতে ওই নবীন ছাত্রছাত্রীরা আমাকে দারুণ সহযোগিতা করেছে। এবং আমি ওই জীবনপাঠগুলো সব সময় চর্চার মধ্যে রাখব। এই ক্যাম্পাস আমাকে নিয়মানুবর্তী হতে শিখিয়েছে। আমাকে শিখিয়েছে কী করে মনপ্রাণ ঢেলে দিয়ে স্বপ্নের পেছনে ছুটতে হয়। এটা বুঝেছি যে ক্যারিয়ার মানেই কেবল বেতন-ভাতা নয়, ক্যারিয়ার মানে আরেকজনের জীবনে ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করা। এই ক্যাম্পাস আমাকে শিখিয়েছে কর্মজীবন মানে অন্যকে অনুপ্রাণিত এবং বেড়ে ওঠায় সহযোগিতা করা। তোমরা প্রস্তুত। তোমরা সুশিক্ষিত।

ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার রোসিয়ের স্কুল অব এডুকেশনের সমাবর্তনে অ্যালিসন ফিলিক্স
ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার রোসিয়ের স্কুল অব এডুকেশনের সমাবর্তনে অ্যালিসন ফিলিক্স

এখান থেকে বেরোনোর পর তোমাদের জীবন চলার পথ হবে মসৃণ—এমনটা বলতে পারলে বেশ হতো। কিন্তু আদতে তোমরা অনেক বাধাবিপত্তির মুখোমুখি হতে যাচ্ছ। গত বছর (২০১৬) আমি অলিম্পিকের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। চেয়েছিলাম, আমার লক্ষ্য হোক অনেক উঁচু। ২০০৪ সালে যখন প্রথমবারের মতো অলিম্পিকে গেলাম তখন আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। সেবার আমি একটি পদক জিতলাম। দ্বিতীয়টিতে জিতলাম দুটি। তৃতীয়টিতে তিনটি। তো খুব স্বাভাবিকভাবেই জীবনের চতুর্থ অলিম্পিক থেকে চারটি পদকই জিতে আসতে চেয়েছিলাম আমি। প্রশিক্ষণও নিচ্ছিলাম কোমর বেঁধে। আমি প্রস্তুত ছিলাম এবং জানতাম, লক্ষ্যটা বেশ শক্ত। আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি কঠিন। কেননা লক্ষ্যটা ছিল ইতিহাস গড়ার। লক্ষ্য অর্জন করা কখনো কখনো জীবনের সবচেয়ে কঠিনতম অংশ হিসেবে আবির্ভূত হয়। আসলে লক্ষ্য অর্জন করা কঠিন নয়; কঠিন হলো যেটিকে মানুষ অসম্ভব বলে ধরে নেয়, সেটি অর্জন করা। সাহসের সঙ্গে স্বপ্ন দেখো। ইতিহাস গড়ার মতো দায়িত্ব নিতে ভয় পেয়ো না।

প্রশিক্ষণের সময় আমি একদিন জীবনের পথ থেকে ছিটকে পড়ার মতো ভয়াবহ এক বাধার মুখোমুখি হলাম। জিমে গিয়ে অনুশীলন করছিলাম, যা আগে আমি হাজারবার করেছি। কিন্তু দিনটি ছিল অন্য রকম। পুল আপ বার থেকে আমি পড়ে গেলাম। গোড়ালি মচকে গেল, একাধিক লিগামেন্ট গেল ছিঁড়ে। ঠিক সে মুহূর্তে মনে হলো, আমার এই মৌসুমটাই মাটি। বুঝতে পারলাম, অলিম্পিকে আমার চতুর্থতম যাত্রার এখানেই ইতি। প্রচণ্ড ব্যথায় গোড়ালি ফুলে উঠছিল। জিমের মেঝেতে শুয়ে অসহায় আমি কাঁদছিলাম ভেউ ভেউ করে। ওটা ছিল জীবনের সেই বাধা, সেই বিপত্তি। যে বাধাবিপত্তির কথা আমি তোমাদের বলছিলাম।

ওই মুহূর্তে গভীরভাবে টের পেয়েছিলাম, অলিম্পিকে যাওয়ার জন্য কতটা মুখিয়ে আছি আমি। কতটা সংকল্পবদ্ধ আমি লক্ষ্য অর্জনের জন্য। শেষমেশ অবশ্য উঠে দাঁড়িয়েছিলাম। তবে একা একা নয়। আমার কোচ ও চিকিৎসক আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করেছিলেন। আমার পরিবার সেখানে ছুটে এসেছিল। আমার দুচোখ বেয়ে যখন কান্না গড়িয়ে পড়ছিল, তখন তাঁরা হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, পুনরায় শুরু করার অনুপ্রেরণা হয়ে। আগেই বলেছি, আমি একা একা উঠে দাঁড়াইনি। তবে উঠে দাঁড়িয়ে স্বপ্ন পূরণের জন্য পরবর্তী পদক্ষেপের সিদ্ধান্ত তখনই নিয়ে ফেলেছিলাম। এখনো জানি না শেষমেশ কী করে আমি সেবার অলিম্পিকে গিয়েছিলাম! তবে অসম্ভবকে সম্ভব করার পথে প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল ভীষণ যন্ত্রণাদায়ক। আস্থা রেখেছিলাম সেরে ওঠার পরিকল্পনা ও প্রক্রিয়ার ওপর। অবশেষে সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহে আমি সেবার পা রাখি অলিম্পিকের আসরে।

রিও অলিম্পিকে আমি আমার লক্ষ্য পুরোপুরি অর্জন করতে পারিনি। তবে সেবার জয় করে আনি তিনটি পদক। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, এটা শিখেছি যে সহযোগিতা পেলে এবং একটি একটি করে পা ফেলতে পারলে সবচেয়ে কঠিন বাধাটিও অতিক্রম করার হিম্মত আমি রাখি। তাই আমি তোমাদের বিশাল স্বপ্ন দেখার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছি। দৃশ্যমান অসম্ভবে ভয় পেয়ো না। অবশ্যই কখনো কখনো ব্যর্থতাকেও বরণ করতে হবে তোমাদের। তবে জেনে রেখো, উঠে দাঁড়ানোর মতো সাহসও তোমাদের আছে। চোখে হয়তো জল চলে আসবে কিন্তু নিজেকে লক্ষ্যের দিকে ঠেলতে হবে। নির্ভীক হয়ে ওঠো। তোমাদের ভবিষ্যৎ রোমাঞ্চে ভরপুর ও উজ্জ্বল। আমি জানি, তোমরা তোমাদের আশপাশের মানুষদের ওপর দারুণ প্রভাব ফেলবে। তোমরা প্রস্তুত। তোমরা সুশিক্ষিত। জীবনে চমৎকারভাবে লড়ে যাও, এই আমার শুভকামনা।

অনুবাদ: মাহফুজ রহমান
সূত্র: ইউসিএস রোসিয়ের স্কুল অব এডুকেশনের ইউটিউব চ্যানেল