জেলার পুলিশ প্রশাসন সামলান তাঁরা

শামসুন্নাহার, ফাতিহা ইয়াসমিন
শামসুন্নাহার, ফাতিহা ইয়াসমিন

স্কুলে ক্লাস শুরুর আগে মাঠে  সমাবেশে গিয়ে মাঝেমধ্যে উপস্থিত হন গাজীপুরের পুলিশ সুপার (এসপি) শামসুন্নাহার। সমাবেশের মধ্যেই তিনি শিক্ষার্থীদের মাদক-সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ-দুর্নীতি থেকে দূরে থাকার শপথ পড়ান। 

কেন এই কাজ? পাঁচবার আইজি ব্যাজ পাওয়া শামসুন্নাহার বললেন, ‘এসপি স্কুলে যায়—এমন বার্তা থাকলে স্কুলের আশপাশে আড্ডাবাজি বন্ধ হবে। মেয়ে শিক্ষার্থীরা এ পেশায় আসতে উদ্বুদ্ধ হবে।’

শামসুন্নাহারের জন্ম ফরিদপুর। এক বছর হয়ে গেছে চাঁদপুর থেকে গাজীপুরে এসপি হয়ে গেছেন শামসুন্নাহার। গাজীপুরে এ বছর ফুটবল প্রতিযোগিতা চালু করেছেন তিনি। নাম হলো মাদকবিরোধী ফুটবল টুর্নামেন্ট। প্রতি ম্যাচের আগে, শুধু খেলোয়াড় না, মাঠের সব দর্শকও এই শপথে শামিল হন। 

দলের খেলোয়াড় বাছাইয়ের ক্ষেত্রে যেন ঝরে পড়া শিক্ষার্থী ও শ্রমিকেরাও সুযোগ পান, সেই চেষ্টা থাকে। শামসুন্নাহার বলেন, ‘ঝরে পড়া মানুষই মাদকে আসক্ত হয় বেশি। তাদের এ কাজে শামিল করতে চাই।’ 

গাজীপুরে  শিল্পকারখানার মালিকদের ডেকে শামসুন্নাহার বলেছেন, ‘পুলিশের নাম ভাঙিয়ে বা অন্য কেউ যদি চাঁদাবাজি করে, তবে সরাসরি আমাকে জানান।’ 

২০০১ সালে বিসিএস পাস করে সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) হিসেবে বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিসে যোগদান করে মানিকগঞ্জ, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ, পুলিশ সদর দপ্তর,  ট্যুরিস্ট পুলিশ, পুলিশ সুপার চাঁদপুরসহ বাংলাদেশ পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন শামসুন্নাহার। ২০১১ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত জাতিসংঘের শাখা অফিস ইতালিতে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

২০০৯ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত পূর্ব তিমুরে জাতিসংঘ মিশনের মাধ্যমে পূর্ব তিমুরে জাতীয় পুলিশের মানবসম্পদ উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে ছিলেন শামসুন্নাহার। জাতিসংঘে দীর্ঘদিন উচ্চ পদে সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের স্বীকৃতিস্বরূপ সাতবার জাতিসংঘ শান্তি পদক লাভ করেন। পেয়েছেন প্রেসিডেন্ট পুলিশ মেডেল পদক (পিপিএম)। 

পুলিশ সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে প্যারেডে প্রথম নারী অধিনায়ক হিসেবে পরপর দুবার নেতৃত্ব দেওয়ার সম্মান অর্জন করেছেন শামসুন্নাহার। বাংলাদেশ উইমেন পুলিশ অ্যাওয়ার্ড পাওয়া শামসুন্নাহার দুই সন্তানের মা।  

অন্যদিকে ঝালকাঠি শহরের বিভিন্ন পার্ক ও শহরের গাবখান সেতুতে অনেক রাত পর্যন্ত স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের আড্ডা হতো।  সাধারণ পোশাকে ফোর্স নিয়ে রাতে সেখানে গেলেন ঝালকাঠির এসপি ফাতিহা ইয়াসমিন। আড্ডা দেওয়া ছেলেদের কাউকে থানায় নিলেন না, কোনো বকাঝকা নেই। এই সময় লেখাপড়া ও ঘরে কাটানোর পরামর্শ দিয়ে অভিভাবকদের সঙ্গে  বাসায় পাঠিয়ে দিলেন। চলতি বছরের জুন মাসে ফাতিহা ইয়াসমিন ঝালকাঠির এসপি হন। এরপর থেকেই এমন অভিনব উদ্যোগ নিচ্ছেন একের পর এক। 

ফাতিহা ইয়াসমিন বললেন, ‘এই ছেলেরা অবুঝ। আমরা ওদের অভিভাবক। ওদের ভুলটা ধরিয়ে দিয়ে সংশোধনের চেষ্টা করি।’ 

গত আগস্ট মাসের এক বৃহস্পতিবার ঝালকাঠি শহরের মোটরসাইকেল ও অন্যান্য যানবাহনের চালক ও আরোহীদের  যাঁদের হাতে বৈধ কাগজপত্র ও হেলমেট পাওয়া যাচ্ছিল, তাঁদের ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানাচ্ছিলেন খোদ জেলার এসপি ফাতিহা ইয়াসমিন। আর কাগজপত্র না থাকলে দিচ্ছিলেন মামলা। এখন প্রতি শনিবার শহরের পেট্রলপাম্প মোড়ে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে এ কাজ করেন তিনি। 

শেরপুর উপজেলার নালিতাবাড়ী উপজেলার মেয়ে ফাতিহা ইয়াসমিন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে বিসিএস দিয়ে পুলিশ অফিসার হন। এরপর এসপি। দীর্ঘ যাত্রা। চড়াই-উতরাই পার হতে হয়েছে অনেক। 

ফাতিহা বললেন, ‘আমি মেয়েদের বলি, আমার মা কখনোই ভাবেননি আমি এসপি হব। আজকের ঝালকাঠির কোনো মেয়ে একদিন এসপি হয়ে শেরপুর যাবে, তখন আমি তাঁকে গিয়ে নিজের পরিচয় দেব। এটা আমার আশা।’ 

ফাতিহা ইয়াসমিনের মুন্সিগঞ্জে এএসপি হিসেবে চাকরিজীবনের শুরু। ২০১২ সালে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনে হাইতিতে যান, সেখানে তিনি লজিস্টিক অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৫ সালে কঙ্গো প্রজাতন্ত্রে ডেপুটি কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ঢাকায় সিআইডি, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন সেন্টার, ডিএমপিতে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার হিসেবে বিভিন্ন সময় দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে এসপি পদে পদোন্নতি হয় তাঁর। ফাতিহা ইয়াসমিন দুই সন্তানের মা। সন্তানেরা মায়ের সঙ্গে ঝালকাঠিতে থাকে। আর স্বামী রফিকুল ইসলাম পেশায় ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ার, থাকেন ঢাকায়।

এভাবেই ঘর এবং প্রশাসন সামলে এগিয়ে চলেছেন দুই নারী এসপি শামসুন্নাহার ও ফাতিহা ইয়াসমিন।