স্তন ক্যানসার নিয়ে এক পুরুষ চিকিৎসকের সংগ্রাম

মো. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন
মো. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন

শুরুতে বা এখনো মানুষ অনেক কথাই বলে। পুরুষ চিকিৎসক হয়ে নারীর ক্যানসার নিয়ে কাজ করার বিষয়টিকে অনেকে সহজভাবে মেনে নিতে পারেন না।  অনেকে গালমন্দ করেন। তবে চিকিৎসক মো. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন এসব কথায় দমে যান না। স্ত্রী মোছাররত জাহান, এক ছেলে, এক মেয়ে, ছেলের বউ—বলতে গেলে পুরো পরিবার ক্যানসার সচেতনতায় কাজ করছে দীর্ঘদিন ধরে।

জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ও  ক্যানসার ইপিডিমিওলজি বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন হাবিবুল্লাহ তালুকদার। এ ছাড়া ১০টি বেসরকারি সংগঠনের জোট বাংলাদেশ স্তন ক্যানসার সচেতনতা ফোরামের প্রধান সমন্বয়কারী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। রাজধানীর লালমাটিয়ায় কমিউনিটি অনকোলজি সেন্টারের উদ্যোক্তাদের একজন এই চিকিৎসক। সেন্টারের নির্বাহী পরিচালক এবং যে ট্রাস্টের অধীনে এই সেন্টার পরিচালিত হচ্ছে, ওই ট্রাস্টের সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করছেন মোছাররত জাহান।

 দেশে ঘটা করে স্তন ক্যানসার সচেতনতা মাস এবং দিবস পালনের উদ্যোক্তাও তিনি। দেশে বর্তমানে নারীদের ক্যানসারের মধ্যে শীর্ষ স্থানে আছে স্তন ক্যানসার আর দ্বিতীয় স্থানে আছে জরায়ু মুখের ক্যানসার। হাবিবুল্লাহ তালুকদার এই দুই ক্যানসার প্রতিরোধে সচেতনতা তৈরির কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ১৯৯৩ সালে জাতীয় ক্যানসার ইনস্টিটিউটে কাজের মধ্য দিয়েই ক্যানসার নিয়ে কাজের শুরু।

হাবিবুল্লাহ তালুকদার বলেন, ‘হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার হিসেবে আউটডোরে দীর্ঘ ১০ বছর স্তন ক্যানসারের রোগীরা আমার কাছে আসতেন। দেখতাম, নারীরা এ রোগটি নিয়ে অনেক সংকোচে থাকেন। তখন এ রোগটি নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা জাগে। ২০০৪ সালে প্রথম স্তন ক্যানসার সেবা সপ্তাহ পালন করি। এর দুই বছর পরে জরায়ু মুখের ক্যানসার নিয়ে কাজ শুরু করি। ২০০৭ সাল থেকে বিভিন্ন প্রচার বা সচেতনতামূলক কার্যক্রম নিয়ে ঢাকার বাইরে যাওয়া শুরু করি। গোলাপি সড়ক শোভাযাত্রা, থিংক পিংক প্রোগ্রামসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মোবাইল ফোন প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আর্থিক সহায়তা দিতে এগিয়ে আসে। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।’

হাবিবুল্লাহ তালুকদার জানালেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি ব্যক্তিগত উদ্যোগে অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের হয়ে কাজ করতে কখনো তেমন বাধা আসেনি। বরং ক্যানসার ইনস্টিটিউটের পরিচালক থেকে শুরু করে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্তাব্যক্তিরা সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। অন্যদিকে শুধু স্ত্রী হিসেবে নয়, নিজ পদাধিকার বলেই মোছাররত জাহান কাজগুলো এগিয়ে নিয়েছেন সব সময়। 

কাজ শুরুর দিকের অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে হাবিবুল্লাহ তালুকদার বললেন, ‘আগে বিভিন্ন কলেজে-বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে স্তন ক্যানসার নিয়ে কথা বললে ছাত্রীরা লজ্জায় মাথা তুলতে পারতেন না। এখন নিজেরাই কথা বলেন।  মায়ের ঋণ শোধ করা যাবে না, কিন্তু জরায়ু মুখের ক্যানসার প্রতিরোধে সচেতনতা তৈরিতে জননীর জন্য পদযাত্রায় তো অংশ নেওয়া যায়, এ কথা বললে অনেকেই এগিয়ে আসেন। মানুষকে বোঝাই, স্তন বা জরায়ু নিয়ে লজ্জার কিছু নেই। জরায়ু সন্তানের জন্মের সঙ্গে আর জন্মের পর প্রথম পুষ্টির জন্য স্তন গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ।’

হাবিবুল্লাহ তালুকদার জানালেন, একটি বেসরকারি টেলিভিশনে নিজে স্তন পরীক্ষা করার নিয়মাবলি নিয়ে আলোচনার পর নিজের বড় বোন ইসমত আরা নাজমা স্তন পরীক্ষা করতে গিয়ে বুঝতে পারেন যে তিনি স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত। তবে প্রায় প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়া ও দেশেই সঠিক চিকিৎসায় এই বোন সাত বছর ধরে ভালো আছেন।

হাবিবুল্লাহ তালুকদারের মতে, পশ্চিমা বিশ্বে ৫০ বছরের বেশি বয়সী নারীদের ঝুঁকি বেশি থাকলেও বাংলাদেশে অজানা কারণে তুলনামূলক কম বয়স অর্থাৎ ৩৫ বছর বয়স থেকেই নারীরা স্তন ক্যানসারের ঝুঁকির আওতায় চলে আসছে।  স্তন ক্যানসার হলে স্তন কেটে ফেলা, চিকিৎসা সম্পন্ন করার জন্য নারীসহ পুরো পরিবারের জন্য যে ধরনের কাউন্সেলিং দরকার, তার অভাব আছে। 

সচেতনতার পাশাপাশি ক্যানসারের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনাও উন্নত হচ্ছে বলে উল্লেখ করলেন হাবিবুল্লাহ তালুকদার। জানালেন, সরকার বিভাগীয় শহরে সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১০০ শয্যার পূর্ণাঙ্গ ক্যানসার চিকিৎসাকেন্দ্র স্থাপনের একটি প্রকল্প অনুমোদন করেছে। ক্যানসার নিয়ে সচেতনতা থেকে শুরু করে চিকিৎসা সম্পন্ন করার পুরো প্রক্রিয়ায় রোগীর পরিবারের পাশাপাশি কমিউনিটির মানুষের অংশগ্রহণের বিষয়টিতে গুরুত্ব দিলেন এই চিকিৎসক। সামাজিক আন্দোলনেরও কোনো বিকল্প নেই বলে উল্লেখ করলেন তিনি।