আফিফার একাকিত্বের সঙ্গী সেলাই

কোনো দেয়ালে ফুলে ছাওয়া গাছের ডালে জোড়া ময়ূর বসা। আবার কোনোটাতে রূপকথার ঝলমলে পোশাক পরা সিনড্রেলা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। অথবা এক পাশে গ্রামের মেয়েরা কলসি মাথায় জল আনতে যাচ্ছে। অথবা কোনোটায় তিনটা তেজি ঘোড়া। বসার ঘরের দেয়ালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও রয়েছেন। আর বাসায় ঢোকার মুখেই স্বাগত জানাচ্ছে রয়েল বেঙ্গল টাইগার।

রাজধানীর ইস্কাটন রোডের পুরো বাসাটাই যেন একটা ছবির গ্যালারি। তবে এই ছবিগুলোই জীবন্ত হয়েছে শিল্পী আফিফা লাইলির সেলাইকর্মে। তিনি সুচ–সুতোয় নিরলস বুনে চলেছেন একের পর এক নিখুঁত শিল্পকর্ম। তাঁর করা হ্যান্ড এমব্রয়ডারি বা সূচিকর্মের ১২৫টিরও বেশি ওয়ালম্যাট রয়েছে। এর মধ্যে ৩৫টি তিনি বাঁধাই করেছেন। বাকিগুলো পলিপ্যাকে যত্ন করে মুড়ে রেখেছেন। কিছু আত্মীয় বন্ধুদের উপহার দিয়েছেন আর বিভিন্ন সময়ে হারিয়ে ফেলেছেন অনেকগুলো চিত্রকর্ম।

আফিফা লাইলি সংসারের প্রয়োজনে এম এ পাস করার পর কোনো চাকরি করেননি। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা করানো, কোচিংয়ে নিয়ে যাওয়া, স্বামী চিকিৎসক বলে বাড়িতে সব সময় আত্মীয়দের ভিড় লেগে থাকায় রান্নাবান্না করতে করতেই সময় অনেক পার হয়েছে। এখন দুই মেয়ে, এক ছেলের তিনজনই দেশের বাইরে। স্বামী চিকিৎসক মীর নজরুল ইসলাম বারডেমের ডার্মাটোলজি বিভাগের অধ্যাপক, তাঁরও ব্যস্ততা বেড়েছে। ছোটবেলা থেকে শখ করে সেলাই করতেন আফিফা। আর এখন শখের পাশাপাশি এই সেলাই আফিফার একাকিত্বের সঙ্গী।

সেলাই করছেন আফিফা লাইলি।  দীপু মালাকার
সেলাই করছেন আফিফা লাইলি। দীপু মালাকার

আফিফা লাইলির জন্ম ১৯৬২ সালে। পটুয়াখালীর খেপুপাড়ার মেয়ে তিনি। দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের পরও পড়াশোনা চালিয়ে যান। সেলাই নিয়ে স্বামী কখনো বিরক্ত হননি। সব সময়ই সহযোগিতা করেন। আফিফা বললেন, একেকটা সেলাই ও প্রচুর খরচ। সুতাই লাগে কয়েক ধরনের। স্বামী কখনোই এতে কোনো আপত্তি করেননি। আর ছেলেমেয়েদেরও ইচ্ছে দেশে ফিরে মায়ের সূচিকর্ম নিয়ে প্রদর্শনীর আয়োজন করবে।

আফিফা লাইলির সেলাই করা বাঘ।
আফিফা লাইলির সেলাই করা বাঘ।

আফিফা বললেন, ‘ক্লাস এইটে যখন পড়ি, বাসার সামনে লেস ফিতাওয়ালা যেত। তাদের কাছে নীল দিয়ে নকশা তোলা কাপড় পাওয়া যেত। তাজমহল আঁকা, মধুরমিলন লেখা। এই রকম কাপড় কিনেই শুরু হলো সেলাই । বিয়ের পরে ননদের কাছ থেকে আরও সেলাই শিখলাম।’

আফিফা মূলত ক্রস স্টিচ, লং স্টিচ, ভরাট প্যাটার্নে ওয়ালম্যাটগুলো সেলাই করেন। বসার ঘরের দেয়ালের বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি দেখিয়ে বললেন, ‘চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর আঁকা বঙ্গবন্ধুর ছবি দেখে বড় মেয়ে কাপড়ে স্কেচ করে দিয়েছিল। সেটা দিয়েই একই রকম দুটো ওয়ালম্যাট বানাই। এর একটা ২০০৯ সালে উপহার দিয়েছিলাম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। ছবিটি গণভবনে আছে।’

আফিফার সব ঘর এমনকি রান্নাঘরের সামনে দরজার পাশেও কাঠের ফ্রেমে সেলাই বাঁধিয়ে রেখেছেন। আলমারি খুলে বের করলেন যত্ন করে রাখা প্রায় ১০০টির মতো সেলাই। গরুর গাড়ি, কলসি কাঁখে গায়ের মেয়ে, আস্তাবল থেকে মুখ বের করা ঘোড়া, হিমালয় পর্বত, শাহজাহান, হরিণশাবক, রানিসহ একেক কাপড়ের ক্যানভাসে একেকটা। জানালেন, নিজ হাতে সংসারের কাজ, রান্না, প্রবাসী ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলা আর সেলাই করে একাকিত্বকে দূরে ঠেলছেন। কথা বলতে বলতে পরম মমতায় হাত বোলালেন নিজের করা সূচিকর্মগুলোয়।