তুমি তোমার হৃৎস্পন্দন শুনতে পাও?

>
কিম নাম জুন (আর এম)
কিম নাম জুন (আর এম)
দক্ষিণ কোরীয় বয় ব্যান্ড ‘বিটিএস’ গান আর নাচ দিয়ে রীতিমতো পৃথিবী তোলপাড় করে ফেলছে। প্রথম কোরীয় গানের দল হিসেবে তারা জায়গা করে নিয়েছে টাইমস ও ফোর্বস সাময়িকীর প্রভাবশালীর তালিকায়। যুক্তরাষ্ট্রের উইম্বলে স্টেডিয়াম থেকে শুরু করে বিলবোর্ড মিউজিক অ্যাওয়ার্ড, গ্র্যামির মঞ্চেও তারা গান পরিবেশন করেছে। গত বছর এই দল জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বক্তৃতা করে। দলনেতা আরএম বিটিএসের মুখপাত্র হয়ে সেই বক্তৃতা দেন। ‘নিজেকে ভালোবাসো’—এই কর্মসূচির অংশ হিসেবে সেদিন কথা বলেছিলেন আরএম।

আমার নাম কিম নাম জুন। আরএম নামেও অনেকে চেনেন। আমি বিটিএসের দলপ্রধান। তরুণদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা পৌঁছে দেওয়ার জন্য এত বড় মঞ্চে আমাদের আমন্ত্রণ জানানোয় আজ আমরা গর্বিত। গত নভেম্বরে ইউনিসেফের সঙ্গে বিটিএস একটি কার্যক্রম শুরু করে, নাম ‘লাভ মাইসেলফ’ (নিজেকে ভালোবাসো)। আমরা বিশ্বাস করি, সত্যিকারের ভালোবাসা তখনই শুরু হয়, যখন একজন মানুষ নিজেকে ভালোবাসতে শেখে। আমরা ইউনিসেফের সঙ্গে ‘এন্ড ভায়োলেন্স’ কর্মসূচিতেও অংশ নিচ্ছি। এই কর্মসূচির লক্ষ্য হচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা শিশু, কিশোর ও তরুণদের সহিংসতা থেকে রক্ষা করা। এই প্রতিটি কর্মসূচিতেই আমাদের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে থাকে আমাদের ভক্তরা, তাদের সক্রিয়তা ও কর্মতৎপরতা দিয়ে। পুরোপুরি আস্থা নিয়ে বলতে পারি, আমরা পৃথিবীর সেরা ভক্ত পেয়েছি।

আজকের বক্তৃতা শুরু করতে চাই আমার নিজের গল্প দিয়ে। আমার জন্ম ইলসানে, দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলের কাছে এক ছোট্ট শহরে। খুব সুন্দর একটা শহর, যেখানে আছে একটা লেক, পাহাড় আর বর্ণিল বার্ষিক ফুল উৎসব। আমি সেখানে দারুণ উচ্ছল আর সুখী শৈশব কাটিয়েছি। একেবারে সাদামাটা একটা ছেলেবেলা। আমি খুব বিস্ময় নিয়ে রাতের আকাশ দেখতাম সে সময়, আর দশটা ছেলের মতোই নিজেকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতাম। আমি কল্পনা করতাম, আমি একটা সুপার হিরো; যে কিনা পুরো পৃথিবীকে রক্ষা করার ক্ষমতা রাখে। আমাদের শুরুর দিকের একটি অ্যালবামের ভূমিকায় এমন একটা লাইন ছিল, ‘আমার হৃদয় কাজ করা থামিয়ে দেয়, যখন এর বয়স ছিল ৯ কি ১০’। সত্যিই তো, আমার মনে হয় ওই বয়সের পর থেকেই অন্যেরা আমাকে নিয়ে কী ভাবছে, কী বলছে এসব নিয়ে আমি দুশ্চিন্তা করতে শুরু করি। তখন থেকেই শুরু করি অন্যের চোখ দিয়ে নিজেকে দেখা। আমি রাতের আকাশ দেখা থামিয়ে দিই, তারা গোনা বন্ধ করে দিই, চোখ খুলে স্বপ্ন দেখা ছেড়ে দিই। আমি অন্যের বানানো ছাঁচে নিজেকে ঠেসে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা শুরু করি। একটা সময় আমি নিজের মনের কথা মুখে আনা ছেড়ে দিই। শুনতে থাকি আশপাশের সবার কথা। কেউ আমার নাম ধরে ডাকত না, এমনকি আমি নিজেও না। আমার মন কাজ করা থামিয়ে দিয়েছিল, আমার চোখও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এভাবেই আমি, আমরা নিজেদের পরিচয় ভুলতে শুরু করি। আমরা একেকজন হয়ে উঠি একেকটা হারিয়ে যাওয়া নাম।

কিন্তু আমার একটা আশ্রয়স্থল আছে, সেটা হচ্ছে সংগীত। আমি যখন এর মধ্যে থাকি, তখন আমার ভেতর থেকে আমি শুনতে পাই, ‘ওঠো, নিজের আওয়াজ শোনো।’ কিন্তু সেই আওয়াজটা শুনতে আমার অনেক সময় লেগেছিল। অনেক পরে বুঝতে পেরেছিলাম, সংগীতই একমাত্র আমাকে আমার নিজের নামে ডাকছে।

এমনকি বিটিএসে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরও অনেক বাধার মুখে পড়তে হয়েছে আমাকে। এখন হয়তো অনেকেই বিশ্বাস করবে না, কিন্তু মানুষ একটা সময় আমাদের ব্যর্থ ভাবত। আমিও তখন হার মেনে ফেলতে চাইতাম। কিন্তু আমি খুব সৌভাগ্যবান যে হাল ছাড়িনি, আমরা কেউই হাল ছাড়িনি। আমি, আমরা তো এভাবেই পদে পদে হোঁচট খেতে থাকব, হাল ছেড়ে দিতে চাইব। কিন্তু আমাদের নিজের সঙ্গে লেগে থাকতে হবে।

বিটিএস এখন এমন একটি দল হয়ে দাঁড়িয়েছে, যারা বিশ্বের সব বড় বড় স্টেডিয়ামে পারফর্ম করছে, যাদের লাখো অ্যালবাম বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু মন থেকে আমি এখনো একজন ২৪ বছর বয়সী সাদামাটা তরুণ।

বিটিএস ব্যান্ডের সদস্যরা। ছবি: সংগৃহীত
বিটিএস ব্যান্ডের সদস্যরা। ছবি: সংগৃহীত

হয়তো একটা সময় আমি জীবনে অনেক ভুল করেছি। আজ সেই আমিকেও আমি গ্রহণ করছি। সব ভুলভ্রান্তি নিয়েই আজকের এই আমি। আগামীকাল হয়তো আমি আজকের চেয়ে একটু বেশি জ্ঞানী হব, সেটাও কিন্তু আমিই থাকব। আমার এই ভুলভ্রান্তিগুলোই এখন আমার জীবনের একেকটা উজ্জ্বলতম নক্ষত্র। এখন নিজেকে ভালোবাসার এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছে গেছি, যেখানে দাঁড়িয়ে আমি আজকের আমিকে ভালোবাসি, ভালোবাসি গত দিনের আমিকে, এমনকি আমি সামনের দিনে যেমন হব, তাকেও ভালোবাসি।

যে কথাটা দিয়ে শেষ করতে চাই, আমাদের লাভ ইউরসেলফ অ্যালবাম মুক্তি আর ‘লাভ মাইসেলফ’ কর্মসূচি শুরুর পর থেকে আমরা ভক্তদের কাছ থেকে একের পর এক মনে দাগ কাটার মতো গল্প শুনছি। নিজেকে ভালোবাসলে জীবনের বাধাগুলো কত সহজে উতরে আসা যায়, তা আমরা জানতে শুরু করেছি। বিশ্বজুড়ে অনেক ভক্তই আমাদের জানাচ্ছেন, নিজেকে ভালোবাসতে শুরু করার পর থেকে তাঁদের জীবনে আসা বদলের গল্পগুলো। এই গল্প আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে, কতটা দায়িত্ব আমাদের ওপর। তাই আমরা এখন আরেকটা পদক্ষেপ নিতে চাই। আমরা নিজেদের ভালোবাসতে শুরু করেছি, এবার আমাদের নিজেদের জন্য কথা বলতে হবে। আমি সবাইকে অনুরোধ করব, নিজের মনের কথাটা শোনো আর বলতে শুরু করো। আমি সবাইকে প্রশ্ন করতে চাই, তোমার নাম কী? পরিচয় কী? কী তোমাকে রোমাঞ্চিত করে? কখন তুমি তোমার হৃৎস্পন্দন শুনতে পাও? তোমার গল্প বলো। আমরা তোমার আওয়াজ শুনতে চাই। তোমার মনের কথা শুনতে চাই। বর্ণ-জাতি-ধর্মে তুমি যে-ই হও না কেন, তুমি যেখান থেকে আওয়াজ দাও না কেন, আমি শুনব। তোমার গায়ের রং, তোমার জাতিসত্তা যা-ই হোক না কেন, সব ভুলে তুমি তোমার মনের কথাটা বলতে শুরু করো।

আমি কিম নাম জুন, বিটিএসের আরএম। আমি একজন অনুপ্রেরণা এবং আমি কোরিয়ার ছোট শহর থেকে উঠে আসা একজন শিল্পী। অনেকের মতো আমিও জীবনে অনেক অনেক ভুল করেছি। আমার অনেক খুঁত আছে, অনেক ভয় আছে। কিন্তু এসব সমেত আমি নিজেকে গ্রহণ করেছি, নিজেকে নিয়ে গর্ববোধ করি। আমি নিজেকে এখন অনেক ভালোবাসি। দিন দিন এভাবেই নিজেকে প্রাধান্য দেওয়ার চেষ্টা করব, ভালোবেসে যাব।

ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আদর রহমান