মাইক্রোসফটের মাহ্জাবীন

>শুরু থেকেই স্বপ্ন নিয়েতে প্রকাশিত হয়েছে অনুপ্রেরণার গল্প। আসছে ৪ নভেম্বর প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। এ উপলক্ষে আজ প্রকাশিত হলো এমন গল্প, যা প্রেরণা জোগায়। 
ফাহিমা মাহ্‌জাবীন চৌধুরী
ফাহিমা মাহ্‌জাবীন চৌধুরী

‘আমেরিকায় চাকরি খোঁজাটাও একটা ফুলটাইম চাকরি,’ ফাহিমা মাহ্জাবীন চৌধুরী কথাটা বললেন বেশ মজা করে। কিন্তু পরের কথাটা আরও অবাক করা, ‘৭৩০টা চাকরির জন্য আবেদন করেছি। আবেদন করার সময় আমি সব গুগল শিটে টুকে রেখেছিলাম। তাই সংখ্যাটা আমার মুখস্থ।’

অথচ বাংলাদেশের এই তরুণী এখন যেখানে কাজ করছেন, সেই প্রতিষ্ঠানে চাকরির খোঁজ তিনি করেননি। চাকরিই তাঁকে খুঁজে নিয়েছে। বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান মাইক্রোসফটের ‘সারফেস ল্যাপটপ’ দলে ‘ডিজাইন ভ্যারিফিকেশন ইঞ্জিনিয়ার’ পদে আছেন তিনি।

যেভাবে মাইক্রোসফটে
নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি থেকে তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস প্রকৌশলে স্নাতক করেছেন ফাহিমা মাহ্জাবীন চৌধুরী। খুব কি ভালো ছাত্রী ছিলেন?

‘নাহ্‌। ক্লাসে সব সময় সামনের দিকে বসতাম। আগ্রহ নিয়ে টিচারদের সঙ্গে কথা বলতাম। গবেষণা আমার খুব ভালো লাগে, তাই টিচাররা পছন্দ করতেন।’ এর সঙ্গে যা যোগ করলেন, তা বোধ হয় সব শিক্ষার্থীরই মনের কথা, ‘সবই ভালো লাগত, শুধু পরীক্ষা ছাড়া।’

স্নাতকে তাঁর থিসিসের বিষয় ছিল সোলার সেল (সৌরকোষ)। তাই ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকো স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর যখন দেখলেন, ক্যাম্পাসে সৌরচালিত গাড়ি নিয়ে কাজ করার একটা ক্লাব আছে, লুফে নিয়েছিলেন সুযোগটা। হাতেকলমে কাজ শেখার, কাজ করার এমন আরও যত সুযোগ পেয়েছেন, সবই কাজে লাগাতে চেষ্টা করেছেন তিনি।

স্নাতকোত্তর শেষ হলো ২০১৮ সালে। চাকরি খোঁজার ‘ফুলটাইম চাকরি’ শুরু করলেন মাহ্‌জাবীন। বলছিলেন, ‘অনেকগুলো জায়গায় আবেদন করার পরও বেশির ভাগ জায়গা থেকেই সাড়া পাইনি। কারণ, প্রথমত আমার অভিজ্ঞতা নেই। দ্বিতীয়ত, আমি তখনো স্টুডেন্ট ভিসায় ছিলাম। স্টুডেন্ট ভিসায় চাকরি করতে হলে কোম্পানির স্পনসরশিপ নিতে হয়। যুক্তরাষ্ট্রে যেহেতু এখন নানা রকম কড়াকড়ি আছে, বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান স্পনসর হতে চায় না।’

যাহোক, অবশেষে এ বছর শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্রের একটি মেডিকেল সরঞ্জাম তৈরির প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন তিনি। ছয় মাস সেখানে কাজ করে যখন মোটামুটি থিতু হয়েছেন, তখনই আসে মাইক্রোসফটে কাজ করার প্রস্তাব। মাহ্‌জাবীন বলছিলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে “রিক্রুটার” বা “হেড হান্টার” বলে একধরনের লোক আছেন। তাঁদের কাজ হলো চাকরিপ্রার্থীর সঙ্গে চাকরিদাতাদের মিলিয়ে দেওয়া। তো এ রকম একজন হেড হান্টার একদিন আমার লিংকডইন প্রোফাইলে নক করে জানতে চাইলেন আমি মাইক্রোসফটে আবেদন করতে চাই কি না।’

শুরুতে মাহ্‌জাবীন খুব একটা উৎসাহ দেখাননি। কারণ, ক্যালিফোর্নিয়া ছেড়ে সিয়াটলে যাওয়ার ইচ্ছা তাঁর ছিল না। তার ওপর অফিসেও তখন বেশ কাজের চাপ। তবু সেই রিক্রুটারের জোরাজুরিতে ইন্টারভিউ দিতে রাজি হলেন। ফোনে প্রায় এক ঘণ্টার ইন্টারভিউ হলো। কেমন ছিল সেই অভিজ্ঞতা?

‘মাইক্রোসফটের একজন ম্যানেজার আমার ইন্টারভিউ নিলেন। শুরুতে তিনি বোধ হয় আমার ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহী ছিলেন না। কারণ, তাঁরা এই চাকরির জন্য দুই বছরের অভিজ্ঞতা চেয়েছেন, আমার সেটা নেই। আমি অবশ্য কথা বলে খুব মজা পেলাম। কারণ, প্রথমত আমার কিছু হারানোর ছিল না। দ্বিতীয়ত, আমি দেখলাম, তাঁর প্রশ্নগুলো খুব মজার। নানা ধরনের বিদঘুটে টেকনিক্যাল সমস্যার কথা বলে তিনি জানতে চাচ্ছিলেন, আমি কীভাবে এর সমাধান করব। বই থেকে গৎবাঁধা প্রশ্ন শুরু করলে আমি নির্ঘাত ডাব্বা মারতাম!’

মাহ্‌জাবীন যে ‘ডাব্বা’ মারেননি, সেটা বোঝা গেল তখন, যখন তাঁকে দ্বিতীয়বার ইন্টারভিউয়ের জন্য ডাকা হলো। মাইক্রোসফট থেকে জানানো হলো, ‘আমরা আবারও ফোনেই তোমার ইন্টারভিউ নেব। তুমি চার ঘণ্টা সময় হাতে রেখো।’

আবার ইন্টারভিউ হলো। কদিন পর মাইক্রোসফট কর্তৃপক্ষ মাহ্‌জাবীনকে জানাল, ‘তোমাকে আমাদের খুবই ভালো লেগেছে। কিন্তু যে পদের জন্য তুমি আবেদন করেছ, সেখানে আমরা তোমাকে নিচ্ছি না।’ এটুকু শুনেই মাহ্‌জাবীন মনে মনে খুশি ছিলেন। কিন্তু তাঁর জন্য চমক অপেক্ষা করছিল আরও। চাকরিদাতারা জানাল, ইন্টারভিউ বোর্ডের একজন মাহ্‌জাবীনকে তাঁর দলে নিতে চান। ব্যস, তল্পিতল্পা গুটিয়ে ক্যালিফোর্নিয়া থেকে চলে এলেন সিয়াটলে।

পথচলা
সিয়াটলে মাইক্রোসফটের কার্যালয়টা বিশাল বড়। ছোটখাটো একটা শহরের মতো। একেকটা ভবনের একেকটা নম্বর। মাহ্‌জাবীন বলছিলেন, ১২০ নম্বর ভবনও তিনি দেখেছেন। মাইক্রোসফটে কাজ শুরু করেছেন প্রায় তিন সপ্তাহ হলো। এখনো ‘অ্যালিস ইন দ্য ওয়ান্ডারল্যান্ড’-এর মতো বিস্ময় নিয়ে এই বিশাল প্রতিষ্ঠানটির আনাচকানাচ ঘুরে দেখছেন তিনি। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ নিয়েও প্রকৌশলীদের কত বড় বড় দল কাজ করে, দেখে মাহ্‌জাবীন আশ্চর্য হন।

ছোটবেলায় অগ্রণী স্কুল অ্যান্ড কলেজে পড়েছেন। বিতর্ক দলের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ছায়া জাতিসংঘ সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন তুমুল আত্মবিশ্বাস নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্চে নেচেছেন, গেয়েছেন। তবে এসএসসি-এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পাননি। মা যখন বলেছিলেন, ‘আত্মীয়স্বজনকে ফোন করে তোমার রেজাল্টটা জানাও,’ কাজটা যে কী ভীষণ কঠিন মনে হয়েছিল!

বলে রাখি, চাকরিদাতারা ফাহিমা মাহ্জাবীন চৌধুরীর গবেষণার বিষয়, কাজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছে। মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিকের ফল কিন্তু কেউ জানতে চায়নি।