সাদের দুনিয়ায় শুধুই ফুটবল

>শুরু থেকেই স্বপ্ন নিয়েতে প্রকাশিত হয়েছে অনুপ্রেরণার গল্প। আসছে ৪ নভেম্বর প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। এ উপলক্ষে আজ প্রকাশিত হলো এমন গল্প, যা প্রেরণা জোগায়।
ফুৃটবলার সাদ উদ্দিন। ছবি: শামসুল হক
ফুৃটবলার সাদ উদ্দিন। ছবি: শামসুল হক

চুলের ছাঁটে ডেভিড বেকহাম। ফিটনেসে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। মাঠের ফুটবলে লিওনেল মেসি। সাদ উদ্দিনের ফুটবল আদর্শে মিশে আছে এই তিনের রসায়ন। ১৫ অক্টোবর বিশ্বকাপ ও এশিয়ান কাপ বাছাইয়ের ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে করেছেন অসাধারণ এক গোল। এই এক গোলেই বাংলাদেশের ফুটবলে আলোচনায় উঠে এসেছেন সিলেটের যুবক। অথচ গত বছর সিলেটে এক সড়ক দুর্ঘটনায় থেমেই যেতে পারত সাদের ফুটবল ক্যারিয়ার।

বাবা জমির উদ্দিন পেশায় মুহুরি (আইনজীবীর সহকারী)। স্বপ্ন দেখতেন ছেলেকে লন্ডনে ব্যারিস্টারি পড়াতে পাঠাবেন। কিন্তু সূর্যটা পশ্চিমে হেলে পড়তেই বাড়ির পাশের কুচাই ইউনিয়ন মাঠে সাদ ছুটে যেতেন ফুটবলের টানে। কুচাই মাঠের পাশেই সাবেক ফুটবলার সোহেল আহমেদ গড়ে তোলেন ফুটবল একাডেমি। একদিন এসে সাদকে ডেকে বলেন, ‘তুমি কি ফুটবল খেলবে?’ সাদ মাথা নাড়িয়ে জানিয়ে দিয়েছিলেন ইচ্ছাটা। সেই থেকে শুরু আনুষ্ঠানিক হাতেখড়ি। নিয়মিত ইউনিয়ন কাপে খেলতে শুরু করেন সাদ। আন্ত-ইউনিয়ন ফুটবলে মাঠে নামলেই ভূরি ভূরি গোল। ম্যাচসেরার পুরস্কার জিতেছেন নিয়মিত। এসব দেখে একদিন বাবা ডেকে বলেন, ‘তুমি কি ফুটবলার হবে বলেই ঠিক করেছ? যদি ফুটবলারই হও, তাহলে আরও ভালোভাবে খেলো। আমার আপত্তি নেই।’ পরিবারের সমর্থন পেয়ে আরও জ্বলে উঠলেন সাদ।

কোচ সোহেল তাঁকে পাঠিয়ে দিলেন ঢাকায়। ফুটবল ফেডারেশনের কোচ সৈয়দ গোলাম জিলানী প্রথম দেখাতেই বুঝেছিলেন সাদ একটু অন্য রকম, ‘ওকে প্রথম দিন দেখে অন্য রকম মনে হয়েছিল। এরপর মাঠে সাদের বল রিসিভিং, ড্রিবলিংয়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম।’ সেটা ২০১৫ সালের ঘটনা। বাফুফে তখন সাফ অনূর্ধ্ব-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপ এবং এএফসি অনূর্ধ্ব-১৯ চ্যাম্পিয়নশিপের জন্য ফুটবলার বাছাইয়ের তোড়জোড় শুরু করেছে। গোলাম জিলানী সাদকে পাঠালেন অনূর্ধ্ব-১৯ ফুটবলের ট্রায়ালে। কিন্তু সেখানে শুরুতেই বাদ পড়েন সাদ। এরপর অনূর্ধ্ব-১৬ সাফের দলে টিকে গেলেন। সিলেটে বাফুফের একাডেমি অনুশীলন ক্যাম্পে উঠলেন সাদ।

সেবার সাফ অনূর্ধ্ব-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপের ভেন্যু ছিল সিলেট স্টেডিয়াম। নিজের জেলায়, ঘরের মাঠে, চেনা দর্শকদের সামনে নিজেকে আরও ভালোভাবে চেনালেন সাদ। গ্রুপ পর্বে দুর্দান্ত খেলে দলকে জেতাতে বড় ভূমিকা রাখেন। এরপর সেমিফাইনালের গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে সাদের একমাত্র গোলে বাংলাদেশ হারিয়ে দেয় আফগানিস্তানকে। ফাইনালে প্রতিপক্ষ ভারত। নির্ধারিত সময়ের ম্যাচে সমতা থাকায় টাইব্রেকারে নিষ্পত্তি হয় খেলা। টাইব্রেকারের শেষ শটটি নেন সাদ। ঠান্ডা মাথায় গোল করে সাদ যেন সেদিনই জানিয়ে দেন, ‘আমি আসছি।’

এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ঢাকায় চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে খেলেন ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে। সাদের নজরকাড়া ফুটবলে মুগ্ধ হয়েছিল সবাই। পরের মৌসুমেই ডাক পান দেশের ঐতিহ্যবাহী ক্লাব ঢাকা আবাহনীতে। আবাহনী তখন প্রিমিয়ার লিগের অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন। এই দলের একাদশে কীভাবে জায়গা করে নেবেন, সেই ভাবনাতেই ঘুম আসে না সাদের। লিগের প্রথম পর্বে বেঞ্চে বসেই কাটাতে হয়েছে। আবাহনীর অস্ট্রিয়ান কোচ জর্জ কোটান সাদকে ভীষণ পছন্দ করতেন। অনুশীলনে সাদের পারফরম্যান্স দেখে দ্বিতীয় পর্বে সাদকে মাঠে নামান কোটান। অভিষেকেই ফেনী সকারের বিপক্ষে গোল। জাতীয় অনূর্ধ্ব-২৩ দলে ডাক পেয়ে যান সাদ।

গত বছর ইন্দোনেশিয়ায় এশিয়ান গেমসে ফুটবলে ইতিহাস গড়ে দ্বিতীয় পর্বে ওঠে বাংলাদেশ। পুরো গেমসেই দারুণ খেলেন সাদ। দ্বিতীয় পর্বে উত্তর কোরিয়ার বিপক্ষে হারের ম্যাচে একমাত্র গোলটি করেন। জাতীয় দলের বর্তমান কোচ জেমি ডের রাডারে তখনই ধরা পড়েন ২১ বছর বয়সী যুবক। অবশ্য সেটা ছিল অনূর্ধ্ব-২৩ দলের প্রতিযোগিতা। কিন্তু জেমি এরপর জাতীয় দলে ডাকতে মোটেও ভুল করেননি সাদকে। গত বছর সেপ্টেম্বরে ঢাকায় হওয়া সাফে জাতীয় দলে অভিষেক হলো সাদের। এরপর সাফ, ফিফা প্রীতি ম্যাচ ও বিশ্বকাপ বাছাই মিলিয়ে খেলে ফেলেছেন আটটি ম্যাচ।

সাদের জাতীয় দলের ম্যাচের সংখ্যা বাড়তে পারত। কিন্তু সাফের পরপরই সাদের জীবনে ঘটে যায় ভয়াবহ দুর্ঘটনা। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় বাঁ পা হারাতে বসেছিলেন। শেষ পর্যন্ত অস্ত্রোপচারের পর সেরে ওঠেন। কিন্তু সাত মাস চোটের কারণে দর্শক হয়ে থাকতে হয়েছে। এই সাত মাস নতুন করে নিজেকে চিনেছেন। মাঠে ফিরতে অনেক কষ্ট করেছেন। কষ্ট করেছেন ফিটনেস ফিরে পেতে, ‘আমি ওই সময় কী পরিশ্রম করেছি, তা বলে বোঝানো যাবে না। চোটে পড়লে অনেকে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। আমি কখনোই ভেঙে পড়িনি। নিয়মিত জিম করেছি, সুইমিং করেছি। মোহাম্মদপুর নদীর ধারে গিয়ে প্রচণ্ড রোদে বালুর ওপরে কন্ডিশনিং ক্যাম্প করেছি।’ সেই পরিশ্রমের ফলই পেয়েছেন ভারতের বিপক্ষে গোল করে। ফ্রি কিকে সেদিন জামাল ভূঁইয়ার পা থেকে হাওয়ায় ভেসে আসা বলটি মাটিতে পড়ার সুযোগ দেননি সাদ। ক্যারিয়ারের প্রথম জাতীয় দলের হয়ে যে গোলটি করলেন, সেই গোলেই থেমে যায় সল্টলেক স্টেডিয়ামের ৮০ হাজার দর্শকের গর্জন।

একটা গোলেই রাতারাতি তারকা বনে গেছেন সাদ, ‘ফেসবুকের ইনবক্সে শুভেচ্ছা পেতে পেতে অস্থির হয়ে উঠেছি। ফোনেও সবাই অভিনন্দন জানাচ্ছেন। কোথাও বেড়াতে বের হলে, মার্কেটে গেলে সেলফি তোলার ভিড় পড়ে।’ কিন্তু এখানেই থেমে থাকতে চান না সাদ। ফুটবলই সাদের ধ্যানজ্ঞান, ‘অবসর পেলেই ইউটিউবে ফুটবলের হাইলাইটস দেখি। ফুটবল ছাড়া অন্য কিছু ভাবতেই পারি না।’ তরুণ প্রজন্মের হাত ধরে বাংলাদেশকে বদলে দেওয়ার স্বপ্নে বিভোর সাদ, ‘জাতীয় দলে বেশির ভাগই তরুণ ফুটবলার। আমরা স্বপ্ন দেখি আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বাংলাদেশ হয়ে উঠবে এশিয়ার অন্যতম সেরা দল।’