নারীরা এগোচ্ছেন ধীরগতিতে

অলংকরণ: আরাফাত করিম
অলংকরণ: আরাফাত করিম

সাংবাদিকতা পেশায় এখনো পুরুষের আধিপত্য। গণমাধ্যমে কর্মরতদের বক্তব্য এবং বিভিন্ন গবেষণার তথ্য বলছে, চাকরিচ্যুতি,যৌন হয়রানিসহ বিভিন্ন নির্যাতনের বেশি শিকার হন নারী সাংবাদিকেরা। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে নারীর সংখ্যাও হাতে গোনা। তবে আগের তুলনায় নারী সাংবাদিকের সংখ্যা বেড়েছে। প্রথম আলো, ডেইলি স্টারসহ কিছু প্রতিষ্ঠানে নারীবান্ধব কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করাসহ নেওয়া হয়েছে কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ।

নারী সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণসহ দক্ষতা বৃদ্ধিতে কাজ করা বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রায় ১ হাজার নারী সাংবাদিকতা পেশায় আছেন।

 বাংলাদেশসহ ১৪৪টি দেশের তথ্যের ভিত্তিতে ‘গ্লোবাল মিডিয়া মনিটরিং প্রজেক্ট ২০১৫’ শীর্ষক প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে সাংবাদিকদের ৮৪ শতাংশ পুরুষ, আর ১৬ শতাংশ নারী। টেলিভিশনে নারী সাংবাদিকদের অর্ধেকের বয়স ১৯ থেকে ৩৪ বছরের মধ্যে। গণমাধ্যম, বিশেষ করে টেলিভিশনে ৬৫ বছর বয়সী নারী সাংবাদিক খুঁজেই পাওয়া যায় না। গ্লোবাল মিডিয়া মনিটরিং প্রজেক্ট ১৯৯৫ সাল থেকে প্রতি পাঁচ বছর পরপর প্রতিবেদন প্রকাশ করছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বললেন, দেশে গণমাধ্যমের সংখ্যা বেড়েছে। বর্তমানে দেশের প্রায় ২০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিভাগে গড়ে ৪০ জন করে শিক্ষার্থী ভর্তি হচ্ছেন। তবে পড়াশোনা শেষ করে কতজন সাংবাদিকতা পেশা বেছে নিচ্ছেন বা বর্তমানে দেশে কত নারী সাংবাদিকতায় আছেন—এ ধরনের তথ্য নেই কারও কাছে।

 ২০১৭ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের অধীনে ‘পেশাদার সাংবাদিকেরা চাকরি নিয়ে কতটা সন্তুষ্ট, একটি গবেষণা মূল্যায়ন’ শীর্ষক গবেষণায় বিভিন্ন গণমাধ্যমের ৩৩৪ জন উত্তরদাতার মধ্যে ১০২ জন বা ৩০ দশমিক ৫৪ শতাংশ উত্তরদাতা ছিলেন নারী সাংবাদিক। এই গবেষণায় কর্মস্থলে নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা আছে বলে মনে করেন ১৮ শতাংশ। ৫৬ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, কর্মস্থলে তাঁদের অবহেলার চোখে দেখা হয়। পুরুষ সহকর্মীদের অসৌজন্যমূলক আচরণের কথা জানান ৫০ শতাংশ। ১০২ জন নারী উত্তরদাতার মধ্যে ৭ জন জানিয়েছিলেন, তাঁরা বিভিন্ন সময়ে কর্মস্থলে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। প্রায় ১০ শতাংশ নারী সাংবাদিক বলেছেন, তাঁরা বর্তমান কর্মস্থলে মাতৃত্বকালীন ছুটি পান না।

বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক পারভীন সুলতানা বললেন, বেশি কাজ করে ‘নারীরাও পারে’ এটা প্রতিষ্ঠিত করার পাশাপাশি সংসার সামলাতে হয় নারীদের। তবে কাজের ক্ষেত্রে মূল্যায়নটা সেভাবে হয় না।

তবে হতাশার মধ্যেও আশার আলো দেখছেন বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের সভাপতি নাসিমুন আরা হক। তিনি বললেন, ‘আমি ১৯৭৩ সাল থেকে সাংবাদিকতা পেশায় আছি। তখন ১২ থেকে ১৫ জন ছিলাম আমরা। ২০০১ সালে যখন নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের যাত্রা শুরু হয়, তখনো নারী সাংবাদিক ১০০ জনে আটকে ছিল, আর বর্তমানে তা প্রায় ১ হাজার জনে পৌঁছেছে। টেলিভিশন সাংবাদিকতায় নারীর উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। নারীরা ফটো ও ভিডিও সাংবাদিকতায় এসেছেন।’

সর্বোচ্চ প্রচারসংখ্যা নিয়ে শীর্ষে থাকা প্রথম আলোতে ফিচার বিভাগ এবং অনলাইনের ইংরেজি বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন দুজন নারী। অপরাধ, সচিবালয় বিটে কাজ করছেন নারীরা। নারীবান্ধব কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে এবং নারী ও শিশু বিষয়ে লেখার জন্য নীতিমালা এবং যৌন হয়রানির বিষয়ে জানানোর জন্য একটি কমিটিও কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটিতে। প্রতিষ্ঠানটিতে রিপোর্টিংসহ মোট নারী কর্মীর সংখ্যা ৬৬ জন।

ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারে কর্মরত মোট নারীর সংখ্যা ৫৩ জন। ডেইলি স্টারের উপসম্পাদকীয়, বিনোদন, ইংরেজি অনলাইনসহ মোট পাঁচটি বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন নারীরা।

গত বছর বাংলাদেশ সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট, জার্নালিজম অ্যান্ড কমিউনিকেশন (বিসিডিজেসি) এবং ইনস্টিটিউট অব কমিউনিকেশন স্টাডিজের এক জরিপে নারী সাংবাদিকদের মধ্যে ১৭ জন লাখ টাকার বেশি মাসিক বেতন পাচ্ছেন (অষ্টম ওয়েজ বোর্ড বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানে) বলে যে তালিকা দেওয়া হয়, তাতেও ছিলেন প্রথম আলোসহ প্রথম সারির গণমাধ্যমের নারী সাংবাদিকেরা।

জাতীয় প্রেসক্লাবে সাধারণ সম্পাদক পদে (পরপর দুবার) দায়িত্ব পালন করছেন ফরিদা ইয়াসমিন। রাজধানীতে হেফাজতে ইসলামের সভায় বেসরকারি টেলিভিশনের সাংবাদিক নাদিয়া শারমিন হামলার শিকার হন। পরে এই সাহসিকতার জন্য ইউএস স্টেট ডিপার্টমেন্টের ‘ইন্টারন্যাশনাল উইমেন অ্যাওয়ার্ড ফর কারেজ’ পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রথম বাংলাদেশি নারীর সম্মাননা পান তিনি।

১৯৭৮ থেকে শুরু করে ২০১২ সাল পর্যন্ত সাংবাদিকতা করেন মাহমুদা চৌধুরী। তিনি বললেন, ‘একসময় নারী সাংবাদিকদের নিয়োগ দিলে কাজের পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাবে বলেও মন্তব্য শুনতে হয়েছে। বর্তমানে পরিস্থিতি পাল্টাচ্ছে। তবে যে গতিতে চিত্রটা পাল্টানোর কথা ছিল, তা হয়তো হচ্ছে না।’

মাহমুদা চৌধুরী নারীদের নিয়োগে গণমাধ্যমের নীতিনির্ধারকদের মনমানসিকতায় পরিবর্তন এবং নারী সাংবাদিকদের যাতে কাজ করার সুযোগ দেওয়া হয়, সে বিষয়টিতে গুরুত্ব দেন।

দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদক তাসমিমা হোসেন ভাষাসহ বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষতা বাড়ানোর পাশাপাশি নারী সাংবাদিকদের নেটওয়ার্কিং বাড়ানো জরুরি বলে উল্লেখ করেন।

নারী সাংবাদিকদের ধরে রাখতে সব কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানিবিরোধী কমিটি করার পরামর্শ দিলেন নাসিমুন আরা হক।